নঈম নিজাম- দাঙ্গা দমনে নোয়াখালী এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। একটানা চার মাস থাকলেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরলেন। মানুষের সঙ্গে কথা বললেন। কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারেননি। বরং নিজের ছাগলটাও হারিয়েছিলেন। নোয়াখালীর দাঙ্গার ধাক্কাটা গিয়ে আঘাত হানল বিহারে। দলে দলে বিহারি এলো আমাদের এ অংশে। আর এ অংশের লোক চলে গেল পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরায়। সন্দেহ, অবিশ্বাস এমনই ভয়াবহ যে ধর্মের ভিতরে একবার প্রবেশ করলে আর শেষ হয় না। মানুষকে শেষ করে দেয়। জীবন করে তোলে অতিষ্ঠ। নারী-শিশুকে করে ঘরছাড়া। মানবতায় নেমে আসে বিপর্যয়। আঘাত হানে রাষ্ট্রের অখন্ডতায়। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা এ ভূখন্ডের সুস্থতা নষ্ট করেছিল। হারিয়েছিল স্বাভাবিকতা। বেড়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও অর্থনীতি। কেন এমন হয়েছিল সে গবেষণা এখনো অনেকে করছেন। আগামীতেও করবেন। কিন্তু আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারিনি সেই ভয়াবহতা থেকে। এবারকার একতরফা পূজামন্ডপ, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়িতে হামলা, মৃত্যু, জটিলতা ভয়াবহতা একটা খারাপ বার্তা দিয়ে গেল আমাদের। জানি না এ ক্ষত আর শুকাবে কি না। আধুনিক সভ্যতার এই যুগে মানুষ আরও খারাপ হয়েছে। ফিরে গেছে আদিম বর্বরতায়। আধুনিকতার আড়ালে বেড়েছে মানুষের ঈর্ষা, হিংসা, বিদ্বেষ, নষ্টামি আর ভন্ডমি। মুখ মুখোশের আড়ালে একটা ভয়াবহ সমাজের পথে এগিয়ে চলেছি আমরা। কেউ জানি না এর শেষ কোথায়।

১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গার খবর গেল মহাত্মা গান্ধীর কাছে। তিনি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বললেন। আহ্‌বান জানালেন দাঙ্গা বন্ধের। গান্ধীর বিবৃতি সংবাদপত্র প্রকাশ করল। কিন্তু বন্ধ হলো না হানাহানি। কলকাতার আগুনের দাবানল ছড়াল নোয়াখালী ও আজকের দক্ষিণ কুমিল্লায়। খবর শুনে ব্যথিত হলেন গান্ধী। ধর্মের নামে বর্বরতা বন্ধে নিজেই চলে আসেন নোয়াখালীতে। সময়টা ১৯৪৬ সালের ৬ নভেম্বর। যাতায়াতব্যবস্থা এখনকার মতো ছিল না। খুব ভয়াবহ অবস্থা ছিল চলাচলে। নৌকা আর হাঁটাপথ ছিল ভরসা। বয়সের কারণে শরীরও ভালো ছিল না গান্ধীজির। দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে চলতেন। দলীয় নেতারা তাঁকে অনুরোধ করলেন না আসতে। কিন্তু তিনি কারও কথা শুনলেন না। মানুষের নিষ্ঠুরতা তাঁকে আঘাত করল। শান্তির পতাকা নিয়ে তিনি এলেন। পাশে দাঁড়ালেন আর্তমানবতার। হেঁটে হেঁটে মানুষের দরজার সামনে গেলেন। কোনো বাধাই তাঁকে আটকাতে পারল না। নেহরুসহ সহযোগীরা জানতে চাইলেন নোয়াখালীতে কত দিন থাকবেন? জবাবে বললেন, যত দিন প্রয়োজন হয় তত দিন। আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। মানবতা রক্ষা করতে হবে। তারপর অন্য কিছু। গান্ধী এসে প্রথম গেলেন চৌমুহনীতে। থাকলেন দুই রাত। বিশ্রামেরও দরকার ছিল টানা জার্নির কারণে। নভেম্বর- শীত শুরু হয়ে গিয়েছিল। চৌমুহনীতে দুই দিন কাটিয়ে ৯ নভেম্বর কাজ শুরু করেন গ্রামগঞ্জে। দিনের পর দিন ঘুরতে থাকেন। মানুষকে বোঝাতে থাকেন।

নোয়াখালী দাঙ্গার হিসাব-নিকাশ সহজ ছিল না। সবকিছু হুট করে শুরু হয়নি। কলকাতা দাঙ্গার সুযোগটা নিয়েছিল এখানকার লোকজন। তখনকার ঘটনাবলির দিকে চোখ রাখলে দেখা যায়, নোয়াখালী অঞ্চলে হিন্দু জমিদারদের একটা আধিপত্য ছিল। ক্ষমতার ব্যবহার, অপব্যবহার ছিল। মুসলমান সাধারণ কৃষকের সঙ্গে দূরত্ব ছিল। আর সে সুযোগটা কাজে লাগান পীর হুসাইনী। তিনি ছিলেন কৃষক প্রজা পার্টির নেতা। পীর হিসেবে এলাকায় তাঁর অনুসারী তৈরি হয়েছিল। ভোট করতেন কৃষক প্রজা পার্টি থেকে। প্রাদেশিক পরিষদে জয়ীও হয়েছিলেন ১৯৩৭ সালে। তবে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পর হেরেছিলেন মুসলিম লীগের কাছে। বিশাল অনুসারী গ্রুপ নিয়ে পীর সাহেবের অবস্থান ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে জমিদার চিত্তরঞ্জন চৌধুরী মুসলমানদের উত্থান মেনে নিতে পারছিলেন না। মনস্তাত্তি¡ক বিরোধ বাড়তে থাকে। তৈরি হতে থাকে সামাজিক দূরত্ব। কলকাতার দাঙ্গার সুযোগ নেন পীর সাহেব পুরোপুরি। প্রথম হামলা হয় লক্ষীপুর রামগঞ্জ করপাড়া জমিদার রাজেন্দ্র লাল চৌধুরীর বাড়িতে। এর আগে এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয় গুজব। ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাধু ত্রিয়াম্বাকানন্দ নামের এক পুরোহিত আসেন জমিদারবাড়ির পূজা করতে। সাধু ত্রিয়াম্বাকানন্দের হাঁটাচলায় একটা বড় মাপের পুরোহিত পুরোহিত ভাব ছিল। সেই ভাব ঘিরে গুজব ছড়ায় জমিদারবাড়ির পূজায় পাঁঠার বদলে মুসলমান তরুণকে বলি দেওয়া হবে এবার। মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হবে পূজামন্ডপ। এ কারণে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাধু এসেছেন। স্থানীয় সাধুদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গুজবে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। জমিদার রাজেন্দ্র লাল চৌধুরীকে বৈঠকের প্রস্তাব পাঠান স্থানীয় পীর সরোয়ার হোসাইনী। তিনি ব্যাখ্যা চান সবকিছুর। জমিদার বিষয়টি এড়িয়ে যান। বসে থাকলেন না পীর সাহেব। তিনি সমাবেশ করে ঘোষণা দিলেন জমিদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। মিথ আছে- জমিদারের মাথা কেটে নেওয়ার বক্তব্যও দিয়েছিলেন পীর হোসাইনী। ব্যস, শুরু হয় হাঙ্গামা; হিন্দুু জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই।

১১ অক্টোবর রাতে করপাড়া চৌধুরী বাড়িতে হামলা হয়। নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে জমিদার রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লড়ে যান। সে হামলা ¯ম্প্রসারিত হয়ে আঘাত হানে নিরীহ হিন্দুদের বাড়িতেও। খুন, ধর্ষণ, লুটপাটে নেমে পড়ে একদল সুযোগসন্ধানী। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো ছিল- চৌমুহনী, সোনাইমুড়ী, চাটখিল, লক্ষীপুরের রামগঞ্জ, ফেনীর কিছু এলাকা। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে নিস্তার পায়নি অবিভক্ত ত্রিপুরার লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ। ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। গান্ধী পায়ে হেঁটে পুরো অঞ্চল ঘুরে বেড়ান। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। দাঙ্গার ভয়াবহতা তাদের বোঝাতে থাকেন। গান্ধীজি কথা বলেন পীর হোসাইনীর সঙ্গেও। কয়েক মাসের চেষ্টায় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে গান্ধী ফিরে যান। কিন্তু নোয়াখালীর আঘাতের পাল্টা তান্ডব ততক্ষণে গিয়ে পড়েছে বিহারে। কলকাতার পরিস্থিতি আবার অস্বাভাবিক হয়। টনক নড়ে ভারতবর্ষের রাজনীতিবিদদের। পরিবেশ শান্ত করার পরিবর্তে বল্লভ ভাই প্যাটেলরা দাঙ্গাকে রাজনীতির দিকে নিয়ে যান। মুসলিম লীগের একাংশও বসে ছিল না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগে অনেক মুসলমান অধ্যুষিত জেলা গিয়ে পড়ে ভারতে। আবার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা থেকে যায় পূর্ব বাংলায়। তড়িঘড়ির বিভক্তিতে সংকটের সমাধান হয়নি। বরং সংকট তৈরি হয় দীর্ঘমেয়াদের; যা এখনো চলছে।

গান্ধী নোয়াখালী থাকাকালে হারিয়েছিলেন নিজের পোষা ছাগলটি। সবাই জানেন ছাগলের দুধ পান করতেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি ইংল্যান্ড থেকে দুটি ছাগল নিয়ে আসেন। যেখানে যেতেন ছাগলগুলো সঙ্গে থাকত। নোয়াখালীতেও ছাগলগুলো আনতে ভুল করেননি। কিন্তু বিপত্তি বাধে সোনাইমুড়ী, চাটখিল পরিদর্শনের সময়। এক রাতে মহাত্মা গান্ধীর ছাগল চুরি হয়ে যায়। সে ছাগল আর পাওয়া যায়নি। একদল প্রচার করে- ছাগলটি নিয়েছেন পীরের অনুসারীরা। তারা ছাগল জবাই করে রান্না করেন। পরে রান্না করা মাংস পাঠান নিরামিষভোজী গান্ধীকে। পীর হোসাইনী রান্না করা মাংস পাঠিয়ে গান্ধীকে ভিন্ন বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। আবার এ নিয়ে অন্য কথাও প্রচার আছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ছাগলটির হদিস পাওয়া যায়নি। ছাগল চুরির ঘটনায় গান্ধী বিস্মিত ও হতাশ হন। নেহরু বার্তা পাঠান দ্রুত ফিরে যেতে। শরীরও ভালো যাচ্ছিল না। গান্ধী ফিরে যান। তবে আশা রেখেছিলেন তাঁর অনুরোধে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বন্ধ হবে। বাস্তবে দাঙ্গা বন্ধ হয়নি। ছাগল চুরির ঘটনায় গান্ধীর মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। মিডিয়ায়ও খবরটি ফলাও করে প্রচার পায়। গান্ধীর ছাগল চুরি নিয়ে নোয়াখালীবাসীকে এখনো অনেকে বিদ্রƒপ মন্তব্য করেন। আবার অনেকে করেন মজা।

নোয়াখালীর দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্রভাব কীভাবে বিহারে পড়েছিল তার কিছু চিত্র পাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। বঙ্গবন্ধু কলকাতার দাঙ্গা, রাস্তাঘাটে মানুষের লাশ পড়ে থাকা, লুটপাটের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরেছেন। নিরীহ মানুষ কীভাবে বীভৎসতার শিকার হয়েছেন তা রয়েছে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে। বঙ্গবন্ধু দাঙ্গা বন্ধে কলকাতায় কাজ করেন। আর্তমানবতার পাশে দাঁড়ান। অসহায় মানুষের খাবার সংগ্রহ করেন। নিজে ঠেলা চালিয়ে চালের বস্তা পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষের দরজায়। ছাত্রদের হোস্টেলে খাবার পাঠান। রাত জেগে পাহারাও দেন সংঘাত বন্ধে। শুধু কলকাতা নয়, বিহারের দাঙ্গার ভয়াবহতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখে গেছেন অনেক কিছু। পাটনায় এক কঠিন পরিস্থিতিতে ঘরহারা মানুষের পাশে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। নিরীহ মুসলমান, হিন্দুদের রক্ষা করেছিলেন তিনি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তখন রাজনীতি করতেন বঙ্গবন্ধু।

সময় চলে যায় পরিস্থিতি বদল হয় না। নিরীহ মানুষের ওপর হামলা এখনো হচ্ছে। মানুষ আধুনিক হচ্ছে। নিজেদের সভ্য দাবি করছে। বাস্তব অতীতের চেয়েও খারাপ। মিথ্যা কুৎসা রটিয়ে এ যুগেও মানুষ দাঙ্গা করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠছে বিষোদগার ও মিথ্যাচারের কেন্দ্র। সাইবার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ দেখি না। রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পাবনা, সুনামগঞ্জে দাঙ্গা ছড়ানো হয়েছিল ফেসবুকের অপব্যবহার করে। এখনো একই কৌশল চলছে। সরকারের ডিপার্টমেন্টের শেষ নেই। কিন্তু সাইবার সন্ত্রাস নিয়ে সবাই নির্বিকার। ভাবখানা এমন- কারও কিছু করার নেই। বড় মন্ত্রী দোষ দেন ছোট মন্ত্রীকে। আর ছোট মন্ত্রী দোষ দেন বড় মন্ত্রীকে। কোথায় আছি আমরা! সাইবার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। কঠোর হাতে পরিস্থিতি সামাল দিন। না দিলে আগামীতে জটিল অবস্থা তৈরি হবে। ভোটের সময় টের পাবেন কত ধানে কত চাল। সাইবার সন্ত্রাসীদের ভাড়া করা হয়েছে বাংলাদেশকে উথালপাথাল করতে। বিদেশে বসে তারা যখন যা খুশি করছে। সব বিষয়ে তৈরি করছে জটিলতা। তার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। প্রশ্ন আসে না মাস্টারমাইন্ড আর অর্থায়নকারী কারা।

আমরা অনেক কিছুই বের করতে পারি না সময়মতো। এবারকার মন্ডপ ও বাড়িঘরে হামলা সরকারের জন্য সতর্কবার্তা। এ বার্তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ভবঘুরে যুবক মন্ডপে অপকর্ম করল। কিন্তু আড়ালে কে ছিল? খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। হনুমানের লেজের আগুনে লঙ্কা পুড়েছে জানি। কিন্তু হনুমানের লেজে আগুন দেওয়ার বুদ্ধি আলাদা ছিল। কুমিল্লার ঘটনার প্রভাব পড়েছে আরও ১০ জেলায়। কী কারণে সে জেলাগুলো সতর্ক হলো না? প্রশ্ন অনেক। উত্তর নেই। গোয়েন্দা তথ্য কি সরকার আগাম পেয়েছিল? না পেলে কেন পায়নি? আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কেন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি? তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু বুঝি না। আইনের শাসনের কেউ ব্যত্যয় ঘটালে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সব বিষয়ে থাকতে হবে জিরো টলারেন্স। অসাম্প্রদায়িক চেতনা মুক্তিযুদ্ধের কষ্টার্জিত অর্জন। সে অর্জনকে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। কারও জন্য হওয়া যাবে না প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সব জটিলতা দূর করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।’ কবি নজরুল বলেছেন, ‘মোরা একটি বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’

আগুনের পরশমণি এখন আর কেউ ছোঁয়ায় না। কবি নজরুলের বাণী সবাই ভুলে গেছে। অসাম্প্রদায়িক নজরুলকে সবাই এখন মুসলমানের কবি বানিয়ে খুশি। তাঁর আত্মজীবনীও কেউ পড়ে না। পুত্রদের নাম তিনি কী রেখেছিলেন তা কারও মনে নেই। নজরুল মসজিদে যেতেন এক পুত্রকে নিয়ে। আরেক পুত্রকে নিয়ে স্ত্রী পূজা দিতে যেতেন মন্দিরে। কুমিল্লার হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন নজরুল। তখন নাম ছিল ত্রিপুরা। আমাদের দাদার আমলের সব দলিলে ত্রিপুরা লেখা। একসময় ত্রিপুরার রাজধানী ছিল আজকের কুমিল্লা শহর। ১৯৬৫ সালের পর নাম বদল হয়েছে। কুমিল্লায় একসময় সুরের ঝঙ্কার তুলতেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও শচীন দেববর্মণ। সংস্কৃতির শহর কুমিল্লা। শহরে একসময় কৃষিমেলা বসত। থাকত যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ, হাউজি। গ্রামগঞ্জে বসত জারি-সারির আসর। ধর্মচর্চারও অভাব ছিল না। মসজিদ থেকে আসত আজানের ধ্বনি। সকালে শুনতাম আসসালাতু খাইরুমমিনান নাউম। মন্দিরে বাজত ঘণ্টা। সন্ধ্যায় উলুধ্বনি শোনা যেত। ভোরে মুসলমান বাড়ি থেকে আসত কোরআনের সুমধুর সুর। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি কুমিল্লা ঘিরে। সবকিছু হারিয়ে গেছে। মানুষ বদলে গেছে। মানুষের মন বদল হয়ে গেছে। কমে গেছে চিন্তার ব্যাপ্তি। কেউ বোঝে না ইসলাম কোনো ঠুনকো ধর্ম নয় যে ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। আমাদের প্রিয় রসুল (সা.) বিদায় হজে বলে গেছেন, যার যার ধর্ম তার তার। অশান্তির অনল আর নয়। শান্তি চাই, স্থিতি চাই। আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে পড়ুক জগতের সব মানুষের মধ্যে।

লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn