বার্তা ডেক্সঃঃ করোনা ভাইরাস মহামারীর আতঙ্ক কাটিয়ে মানুষ যখন স্বাভাবিকতায় ফিরতে চাইছে, সে সময় দেশে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ধর্ষণ, গণধর্ষণের ঘটনা ভয়ানক উদ্বেগে ফেলেছে নাগরিকদের। ক্ষুব্ধ-বিহ্বল মানুষ প্রতিবাদে নেমেছে রাজপথে। করোনাকালে গতকাল শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও বিক্ষোভে উত্তাল ছিল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও।সারাদেশে অব্যাহত নারী-শিশু নির্যাতনে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করাসহ সব ধর্ষণের বিচার নিশ্চিতের দাবিতে টানা পঞ্চম দিনের মতো গতকালও রাজধানীর রাজপথ ছিল উত্তাল। দিনের শুরুতেই বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠনের ব্যানারে রাস্তায় নেমে আসেন নগরবাসী। ধর্ষণের মতো বর্বরোচিত নির্যাতন এবং তা মোবাইল ফোনে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো অসভ্য কা-ের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, জাতীয় প্রেসক্লাব, রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, সংস্কৃতিকর্মী, ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। তারা ধর্ষণবিরোধী ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। মিছিল, প্রতিবাদ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন তারা। শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী মহাসমাবেশ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর

পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবি জানায় বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলো। ‘ধর্ষণ ও নির্যাতনবিরোধী বাংলাদেশ’ ব্যানারে গতকাল বিকালে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই সমাবেশ হয়। সেখানে ধর্ষণ ও নিপীড়ন বন্ধে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স। দাবিগুলো হলো- সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ-নারীর প্রতি সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণ, নিপীড়ন বন্ধ ও বিচারে ‘ব্যর্থ’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। পাহাড়-সমতলে নারীদের ওপর সামরিক-বেসামরিক সব ধরনের যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতনবিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে। সিডও সনদে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে। ধর্মীয়সহ সব ধরনের সভা-সমাবেশে নারীবিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন বন্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে বিটিসিএলের কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিকচর্চায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। তদন্তকালে ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ভিকটিমের আইনি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে অনিষ্পন্ন সব মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে হবে। ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ১৫৫(৪) ধারা বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য-প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক যে কোনো প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পরিচ্ছেদ, ছবি, নির্দেশনা ও শব্দ চয়ন পরিহার করতে হবে। গ্রামীণ সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।

সমাবেশে নাসির উদ্দিন প্রিন্স বলেন, আমরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক জাগরণ তৈরি করব সারাদেশে। ধর্ষণকে উচ্ছেদ করে ছাড়ব এ দেশ থেকে। দাবি আদায়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় বলেন, ১৬ অক্টোবরের মধ্যে দাবি মেনে না নেওয়া হলে আমরা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ অভিমুখে ধর্ষণবিরোধী লংমার্চ করব। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে ‘ধর্ষণ ও নির্যাতনবিরোধী বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান নেবে। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় ধর্ষণবিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেন অনিক। মহাসমাবেশের শুরুতে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এই পর্বটি সঞ্চালনা করেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন।

মহাসমাবেশে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও অনেকে এসে যোগ দেন। এ সময় তাদের হাতে ছিল নানা স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড। প্রতিবাদমুখর ছিল জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরও। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে গতকাল সকাল থেকেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে প্রেসক্লাব চত্বর ও আশপাশ এলাকা। দেশে ধর্ষণ, যৌন হয়রানির প্রবণতা বৃদ্ধির প্রতিবাদে সামাজিক প্রতিরোধের দাবিতে নাগরিক ঐক্য, ফিউচার অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কনফেডারেশন অব লেবার (বিসিএল), জাতীয়তাবাদী মহিলা দল, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল, নেজামে ইসলাম পার্টি, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, ঢাকাস্থ নোয়াখালী বেগমগঞ্জ ঐক্য পরিষদ, খেলাফত মজলিস, অলিন্দের সদস্যরা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যানার হাতে প্রতিবাদ জানান। তাদের ব্যানারে লেখা ছিল- ‘আমার বোন আজ ধর্ষিতা মানুষ তুমি চুপ কেন?’, ‘ধর্ষকদের বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন কর’, ‘ধর্ষণকারীর ফাঁসি চাই’, ‘বঙ্গবন্ধুর এই বাংলায় ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’, ‘চলো যাই যুদ্ধে ধর্ষণের বিরুদ্ধে’ ইত্যাদি।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সমাবেশে বক্তারা বলেন, সরকারের মন্ত্রীরা বলেন, ‘আমেরিকা-ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে নারী নির্যাতন কম হয়’। ধর্ষণের ঘটনায় মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলেন। তা হলে আমরা কোন দেশে বাস করছি? তিন বছরের কন্যাশিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা ধর্ষণকারীদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এরকম একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশে। এদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নবিহীন ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে আয়োজিত এক সমাবেশে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, আরেকটি ১/১১ ঘটাতে মরিয়া সরকার। এ বিষয়ে আপনারা সতর্ক থাকবেন। সরকারের এ চক্রান্ত কোনো দিনই আমরা সফল হতে দেব না। প্রয়োজনে জীবন দিয়ে গণতন্ত্র রক্ষা করব। সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, অধ্যাপক ড. আব্দুজ জাহের, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বামজোট নেতা সাইফুল হক। সংহতি প্রকাশ করেন অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রমুখ।

অন্যদিকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ ও এতে সহযোগিতার অভিযোগে করা মামলার ১৮ দিন পেরিয়ে গেলেও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরসহ কোনো আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে ছাত্রলীগ। বিকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অনশনরত ওই ছাত্রীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ ও সারাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি ও সমাবেশে এ হতাশার কথা ব্যক্ত করেন সংগঠনটির নেতারা। ওই ছাত্রী বৃহস্পতিবার রাতে অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে অনশনে বসেন।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস এবং সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান এবং দক্ষিণের সভাপতি মেহেদী হাসান, সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের হোসেন প্রমুখ। সমাবেশে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের বোন একটি মামলা করেছে। যেখানে একটি সংগঠনের শীর্ষ নেতাকে আমরা জড়িত থাকতে দেখেছি। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছি- ধর্ষক যে-ই হোক, আপনারা তাকে গ্রেপ্তার করুন। শাহবাগে আন্দোলনকারীরা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, এরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে চায়। কেন সরকার নিয়ে আপনাদের কী সমস্যা? সবাইকেই তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে বাবা তার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, সেখানে নৈতিক স্খলন ছাড়া আর কোনো কারণ আছে?-আমাদের সময়

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn