বার্তা ডেক্সঃঃ বাগেরহাটের মোংলায় আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় পিতৃহীন ৭ বছরের এক শিশু ধর্ষণের অভিযোগে আব্দুল মান্নান সরদারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত-২ এর বিচারক মো. নূরে আলম। সোমবার দুপুর ১২টায় জনাকীর্ণ আদালতে আসামির উপস্থিতিতে এই রায় ঘোষণা করা হয়। মাত্র সাত কার্য দিবসে ঐতিহাসিক এ রায় ঘোষণা করেন বিচারক। রায়ে আসামিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ১ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। এর আগে রোববার দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত টানা ৩ ঘণ্টা বাগেরহাট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মো. নূরে আলম এই চাঞ্চল্যকর মামলার বাদী-বিবাদী পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনেন। বাগেরহাটের স্পর্শকাতর একটি ফৌজদারি মামলায় ৭ কার্যদিবসে বিচার কাজ শেষ করার নজির বাংলাদেশে এই প্রথম। আসামি আব্দুল মান্নান সরদার (৫০) মোংলা উপজেলার মাকোড়ডোন গ্রামের ভূমিহীন আশ্রয় প্রকল্প এলাকার প্রয়াত আহম্মদ সরদারের ছেলে। এদিকে, বাগেরহাটের বিচার বিভাগ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের একটি মামলার বিচার কাজ কম সময়ের শেষ করে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখায় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন নারী উন্নয়ন ফোরাম।

এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিচারকার্যের যে দীর্ঘসূত্রিতা ছিল বা সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের বিচার না পাওয়ার যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল  তা অনেকাংশে দূর হবে বলে মত তাদের। মামলার নথি থেকে জানা গেছে, বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার মাকোড়ডোন গ্রামের ভূমিহীন আশ্রয় প্রকল্প এলাকায় পিতৃহারা সাত বছর বয়সী এক শিশু তার মামার বাড়িতে থেকে বড় হচ্ছিল। গত ৩রা অক্টোবর বিকাল সাড়ে চারটার দিকে ওই আশ্রয়ন প্রকল্পের পঞ্চাশোর্ধ প্রতিবেশী আব্দুল মান্নান সরদার শিশুটিকে বিস্কুট খাওয়ার প্রলোভন দিয়ে নিজের ঘরে ডেকে নেয়। এরপর শিশুটিকে ধর্ষণ করে মান্নান। পরে এই ঘটনা জানাজানি হলে ওইদিন রাতেই মেয়েটির মামা মোংলা থানায় আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোংলা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বিশ্বজিৎ মুখার্জী তদন্তে ধর্ষণের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে ১৬ জনকে সাক্ষী রেখে আটদিনের মাথায় আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে ১১ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। বাগেরহাট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতের বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) গোপাল চন্দ্র পাল বলেন, মামলাটি স্পর্শকাতর হওয়ায় জুডিশিয়াল আদালত মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে পাঠায়। আদালতের বিচারক গত ১১ই অক্টোবর মামলাটি আমলে নিয়ে পরদিন চার্জ গঠন করেন। ১৩ই অক্টোবর বাদী পক্ষের মোট ১৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। ১৪ই অক্টোবর মামলার সংশ্লিষ্ট সাক্ষী চিকিৎসক, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, নারী পুলিশ সদস্য এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।

১৫ই অক্টোবর আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনে সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্য নেন। রোববার বাদী বিবাদী পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে রায়ের দিন ঘোষণা করেন। এই ধরনের ফৌজদারি মামলায় দেশের কোনো নিম্ন আদালতে কম সময়ে বিচারকাজ শেষ হয়নি বলেও জানান এই কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বাগেরহাট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ সহকারী কৌঁসুলি (এপিপি) রণজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সুস্পষ্ট বলা আছে কোনো ধর্ষণের ঘটনার অভিযুক্ত সঙ্গে সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়লে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন করা যাবে। এই শিশু ধর্ষণের মামলাটি তারই প্রমাণ। মামলাটি পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করেছে। ঘটনার পরপরই আসামিকে গ্রেপ্তার,  ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষা, সাক্ষী হাজির এবং অভিযোগপত্র দাখিল যথা সময়ে করেছে পুলিশ। আইন মেনে ধর্ষিতা শিশুটির ২২ ধারা ও ১৬১ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচারকের বিচার কাজ শেষ করতে সময়ক্ষেপণ হয়নি। মামলাটি শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। রোববার টানা তিন ঘণ্টা বাদী-বিবাদীর যুক্তিতর্কের উপর শুনানি শেষে সোমবার এই আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা করার হয়। বিগত দিনে এতো কম সময়ে দেশের কোনো আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কোনো রায় ঘোষণা হয়নি বলেও জানান এই আইন কর্মকর্তা।

সম্প্রতি দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন অস্বাভাবিকহারে বেড়ে গেছে। যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে দেশব্যাপী। এই সময়ে রায় ঘোষণার মধ্যে দিয়ে মানুষের মধ্যে যে বিচারহীনতা বা মামলার দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে তা অনেকটাই দূর হবে বলে মনে করেন তিনি। নারী উন্নয়ন ফোরামের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী  ও সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান উন্নয়নকর্মী রিজিয়া পারভীন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সম্প্রতি বাগেরহাটের মোংলা দরিদ্র পরিবারের একটি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৭ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার কাজ শেষ করেছেন। এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিচার কার্যের যে দীর্ঘসূত্রিতা ছিল বা সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের বিচার না পাওয়ার যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল তা অনেকাংশে দূর হবে। দেশের সকল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলে মত দেন এই নারী নেত্রী।-মানব জমিন

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn