বিল্লাল হোসেন রবিন-নারায়ণগঞ্জে হকার ইস্যুর নেপথ্যে রয়েছে কোটি টাকার চাঁদাবাজি। আর এই চাঁদার টাকার ভাগ যায় হকার নেতা, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ও কথিত সাংবাদিকদের পকেটে। ফলে কখনই স্থায়ীভাবে ফুটপাথ হকারমুক্ত হয়নি। বছরের পর বছর ধরে উচ্ছেদের নামে চলে ইঁদুর-বিড়াল খেলা। সিটি করপোরেশন সকালে উচ্ছেদ করলে বিকালে যেই সেই। আবার যে যার মতো বসে পড়ে।চাঁদা ভোগকারীদের সহযোগিতা থাকায় হকাররা কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই ফুটপাথ দখল করে তাদের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। যদিও জরুরি অবস্থার সময় নাসিক ফুটপাথ হকারমুক্ত রাখতে চাষাঢ়ায় হকার্স মার্কেট করে দিয়ে পৌনে ৭শ’ হকারকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। কিন্তু আবার ফুটপাথ হকারে ভরে যায়। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। খোদ নাসিক মেয়র অভিযোগ করেন, হকার্স মার্কেটের দোকান বিক্রি করে বা অন্যের কাছে ভাড়া দিয়ে নিজেই আবার ফুটপাথ দখল করে বসেছে। প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে তিনি স্থায়ীভাবে ফুটপাথ হকারমুক্ত রাখতে পারেননি বলেও গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করে শহর থেকে স্থায়ীভাবে হকার উচ্ছেদ হলো কেন? সবাইকে নিয়মিত চাঁদা দিয়েই তো আমরা ব্যবসা করে আসছি। সিটি করপোরেশন উঠিয়ে দিলে আমরা আবার বসে পড়ি। এভাবেই তো চলে আসছে। এবার এমন হলো কেন? এ প্রশ্ন সাধারণ হকারদের।

এদিকে হকার উচ্ছেদের পর মাঠে নামেন হকার নেতারা। সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক নেতা আর কথিত সাংবাদিক। ফলে হকার আন্দোলন মারমুখী হয়ে উঠে। কিন্তু উচ্ছেদের পর হকাররা ১৮/১৯ দিন শান্তিপূর্ণভাবে তাদের আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। নানা আলোচনা-প্রস্তাবনার মধ্যে সাধারণ হকাররা আশার আলো দেখছিলেন। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবারের সংঘর্ষের পর হকারদের একটি অংশ বলছে এতে তাদের কপাল পুড়েছে। যাও একটু বসার সুযোগ হতো এখন সে সুযোগও হারাতে হয়েছে। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হকার ইস্যুর মূল কারণ মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি। সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বিও শনিবার নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে সাংস্কৃতিক জোটের মানববন্ধনে বলেছেন, আজকে হকারের যে ইস্যু, তার নেপথ্যে একমাত্র অর্থ জড়িত। হকার নেতৃবৃন্দ যারা তাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিমাসে সোয়া কোটি টাকা এই হকারদের কাছ থেকে উঠে। তারা সোয়া কোটি টাকা প্রতিমাসে চাঁদা তুলে। এই টাকা কোথায় যায়? কাকে দেয়? শামীম ওসমান এই নারায়ণগঞ্জে হকারদের পাশে এমনি এমনি দাঁড়াবেন?
সরজমিন শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, শহরের চাষাঢ়া গোল চত্বরের চারপাশ এবং শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু সড়কের চাষাঢ়া থেকে মণ্ডলপাড়া পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে প্রধানত সবচেয়ে বেশি হকার বসে। এছাড়া শহীদ মিনার, শায়েস্তা খান সড়ক, চেম্বার রোড, ২ নং রেল থেকে ১ নং গেইট, ১ নং গেইট থেকে কালিরবাজার, কালিবাজার থেকে ব্যাংকের মোড়, লুৎফা টাওয়ার গলি, প্রেসিডেন্ট রোড গলিতে ফুটপাথ দখল করে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসে হকার। এই সব স্থানে প্রায় দেড় হাজার দোকান। এরমধ্যে স্থায়ীভাবে ৫ শতাধিক। যারা কখনো উচ্ছেদের কবলে পড়ে না। বেশিরভাগ সময় উচ্ছেদের শিকার হয় বঙ্গবন্ধু সড়কের দুইপাশের ফুটপাথের দোকানিরা। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ আবার অস্থায়ী। কেউ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেউ শুধু বিকালে কেউ বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বসে। কিন্তু চাঁদা দিতে হয় সবাইকে সমানতালে। ফুটপাথের এই সব দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলা হয়। তবে দোকান বুঝে বা ব্যবসার ধরন বুঝে দৈনিক সর্বনিম্ন ৯০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। বেশ কয়েকজন হকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাঁদার টাকার পরিমাণে ভিন্নতা রয়েছে। যারা শরবত বিক্রি করেন তাদের দিতে হয় ৩০ থেকে ৫০ টাকা। যারা ডিম বিক্রি করেন তাদের দিতে হয় ৩০-৪০ টাকা।  চটপটি দোকানিকে ১০০ টাকা, যারা বড় করে জামা-কাপড়, জুতা, ইলেক্ট্রনিক্স দোকান, মোবাইল এক্সেসরিজ, ফলের দোকান তাদের দিতে হচ্ছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। হকারদের দাবি, পুলিশের পাশাপাশি এ চাঁদা যায় বেশ কয়েকজন হকার নেতা ও রাজনৈতিক নেতার পকেটে। এছাড়াও ফুটপাথ ঘেঁষে ভ্যানগাড়ি নিয়েও ভাসমান দোকান বসিয়ে হকাররা ব্যবসা পরিচালনা করছে। যাদের কাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৫০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
বর্তমানে হকারদের নেতৃত্বে থাকা রহিম মুন্সি, আনোয়ার মুন্সি, দুলাল মুন্সি, আসাদুল ইসলাম ও গোবিন্দ। তাদের নেতৃত্বে রয়েছে আরো অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। যারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ফুটপাথের এরিয়া অনুযায়ী চাঁদা তুলে থাকেন। এরমধ্যে চাষাঢ়া গোল চত্বরে নরসিংদীর রহিম মুন্সী নিজেই তোলেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর  হকার্স লীগের সভাপতি, তার সঙ্গে রয়েছেন টাঙ্গাইলের আনোয়ার মুন্সী, রায়হান, সাধু পৌলের গির্জার সামনে মহসিন, মঞ্জিল ও দুলাল মুন্সি। নারায়ণগঞ্জ ক্লাব সংলগ্ন ফুলের দোকানের সামনে নিধির দাস, পুরান কোর্ট তুলাপট্টির সামনে বিহারী গুজা চেয়ারম্যান, চশমা দোকানগুলোতে সেলিম, মুন্সীগঞ্জের নিজাম, তাহের মুন্সী, নারায়ণগঞ্জ কলেজের সামনে রফিক, ২নং রেল গেইট ও আশেপাশের এলাকায় পলাশ, পাট ভবনের সামনে তিন ভাই,  মোতালেব ভাণ্ডারী, সোলেমান, মণ্ডলপাড়ায় চোরাই মোবাইলের লিটন, সকালে দিগুবাবুর বাজার সংলগ্ন কাঁচাবাজারে শুক্কুর, জাকির, শীলার মা, নয়ন সুপার মার্কেটের সামনে সোহেল ও আকতার,  ভাসমান (ভ্যান গাড়িযোগে) ফাস্টফুডের দোকান এক ফটো সাংবাদিক, বঙ্গবন্ধু সড়কে ১৮টি চটপটি দোকান থেকে ইন্সপেক্টর (অব.) নজরুল, কথিত এক সাংবাদিক প্রতিদিন একাই ভাসমান ফাস্টফুটের গাড়ি থেকে ৭ হাজার টাকা। এছাড়াও গোবিন্দ (নাসিক কর্মচারী), বরিশালের শহিদ, নাসির ওরফে কাইল্লা নাইচ্ছা, স্থানীয় মাস্তান ও ছিনতাইকারী লিপ্পা ওরফে লিপুসহ আরো কয়েকজন চাঁদাবাজ প্রতিদিন চাঁদাবাজি করে আসতো।  
এদিকে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র বড় দিন ২৫শে ডিসেম্বর সাধু পৌলের গির্জার সামনের ফুটপাথ খালি রাখতে পূর্ব থেকেই পুলিশ সুপার মঈনুল হক দফায় দফায় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহিন শাহ পারভেজকে নির্দেশ দেয়ার পরও সকালে গির্জায় প্রবেশকালে হকারদের দখলের বিষয়টি দেখে পুলিশের বেতারযন্ত্রে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ার নির্দেশনার কারণ জানতে চাইলে প্রতি উত্তরে শাহিন শাহ পারভেজ আপত্তিজনক মন্তব্য করলে তাৎক্ষণিক থানা থেকে ওসি শাহিন শাহ পারভেজকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। এরপর থেকেই হকার উচ্ছেদে কঠোর হস্তে মাঠে নামে পুলিশ। উচ্ছেদ হয়ে হকাররা ছুটে যায় নাসিক মেয়র, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান ও জেলা প্রশাসকের কাছে। প্রশাসন ও নাসিক কঠোর থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত হকার বসতে পারেনি। কিন্তু হকারদের পক্ষে সরাসরি শামীম ওসমান মাঠে নামলে পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে যায়। কিন্তু মঙ্গলবার পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করে। তবে পুলিশের বর্তমান তৎপরতার কারণে বঙ্গবন্ধু সড়কে এখন আর হকার বসতে পারছে না। কয়েকজন সাধারণ হকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা মনে হয় কোনো রাজনীতির শিকার হলাম। শেষ পর্যন্ত আমাদেরই কপাল পুড়লো মনে হয়। এদিকে ফুটপাথ থেকে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে জানতে হকার নেতা ও মহানগর হকার্স লীগের সভাপতি আব্দুর রহিম মুন্সি ও হকার্স সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আসাদুল ইসলাম আসাদের সঙ্গে গতকাল যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn