চিররঞ্জন সরকার-

জাতিসংঘ, আরব ও মুসলমান দেশসহ অন্যান্য মার্কিন-মিত্রদের আপত্তি আমলে না নিয়ে মুসলমানদের পুণ্যভূমি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এই ঘোষণায় কার সবচেয়ে বেশি লাভ হবে? নিঃসন্দেহে অস্ত্র বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলি! কেননা এই ঘোষণার কারণে মধ্যপ্রাচ্য আবার উত্তপ্ত হবে। আবারও কিছু নয়া চরমপন্থী দলের উত্থান হবে, আর তাদের ‘ঠাণ্ডা’ করতে ‘শান্তির বাহক’ আমেরিকাকে অস্ত্র সহ সেখানে যেতে হবে!

জেরুজালেম আসলে কার? দশকের পর দশক ধরে এই প্রশ্নেই উত্তাল হয়ে রয়েছে ইজরাইল ও প্যালেস্টাইনের সম্পর্ক। প্রাচীন এই শহরটি একই সঙ্গে মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের পবিত্রভূমি। অথচ অভিযোগ, ১৯৮০-তে জবরদখল করেই শহরটিকে নিজেদের রাজধানী বলে ঘোষণা করে ইজরাইল। তারও আগে থেকে চলছিল একের পর এক ‘অবৈধ’ ইহুদি বসতি গড়ার কাজ। প্যালেস্টাইন যা কখনওই মেনে নেয়নি। এত দিন জেরুজালেমকে ইজরাইলের রাজধানী হিসেবে মান্যতা দেয়নি বাকি দুনিয়াও। ট্রাম্পের তাই এমন উল্টো পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত, পশ্চিম এশিয়ার শান্তি প্রক্রিয়াকে একেবারে খাদের ধারে এনে দাঁড় করাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে কূটনীতিক মহল। তা হলে কি ফের রক্তে ভাসবে গাজা ও পশ্চিম ভূখণ্ড?  সিরিয়ার পরিস্থিতির ফলে ওই অঞ্চল অগ্নিগর্ভ হয়ে রয়েছে। এই ঘোষণার ফলে প্যালেস্টাইনে ফের আগুন জ্বলতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনও বলেছেন, ‘পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে প্রেসি়ডেন্ট এখনও আগের মতোই দায়বদ্ধ।’ টিলারসন জানিয়েছেন, তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কাল ট্রাম্প নিজে থেকেই ফোন করে কথা বলেছেন প্যালেস্টাইনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে।

দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে কী কথা হয়েছে, তা প্রকাশ করেনি কেউই। ফলে অস্বস্তি থাকছেই। ইরান, তুরস্ক, ফ্রান্স, জর্ডন, মরক্কো ও মিশরের রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই ফোনে কথা বলেছেন আব্বাস। পাশে থাকার ব্যাপারে তাঁদের কাছ থেকে সাড়াও পেয়েছেন। আমেরিকার এই ‘চক্রান্ত’ মেনে নেওয়া হবে না বলে তোপ দেগেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। এর প্রতিবাদে গোটা মুসলিম দুনিয়াকে একজোট হওয়ার ডাক দিয়েছেন তিনি। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এরদোগান আগামী ১৩ ডিসেম্বর থেকে ‘অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন’-এর শীর্ষ বৈঠক ডেকেছেন। ট্রাম্পকে এ ধরনের ঘোষণা না-করার অনুরোধ জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিসও। ট্রাম্প যে এমন একটা কিছু করতে পারেন, কয়েক দিন ধরেই তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। অভিন্ন জেরুজালেমকে চিরদিনই নিজেদের রাজধানী বলে দাবি করে এসেছে ইজরাইল। কিন্তু ১৯৬৭ সালে ইজরাইল যে ভাবে পূর্ব জেরুজালেমের দখল নেয়, তা নিয়ে আপত্তি রয়েছে প্যালেস্টাইনের। সেখানে ইহুদিদের কয়েক ডজন ‘অবৈধ’ বসতি সত্ত্বেও, এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ প্যালেস্টাইনিরাই। বরাবর তারা বলে আসছে, পূর্ব জেরুজালেমই হবে স্বাধীন প্যালেস্টাইনি রাষ্ট্রের রাজধানী। তাদের আশঙ্কা, গোটা জেরুজালেমটাই ইজরাইলের নামে করে দিয়ে আমেরিকা এখন স্বাধীন প্যালেস্টাইনের সম্ভাবনাটাই নস্যাৎ করে দিতে চাইছে।

ইতিহাসের দিকে ফিরলে আমরা দেখতে পাই ১৯৪৮ এ ইজরাইল রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকেই তা প্যালেস্টাইন তথা আরব দুনিয়ার সঙ্গে (মার্কিন ও ন্যাটোর মদতে) বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। অথচ বিশ শতকের প্রথম দিকেও প্যালেস্টেনীয় ও ইহুদি জাতিসত্তার আন্দোলনের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। ১৯২০-র ফ্রান্স-সিরিয়া যুদ্ধে সিরিয়ার পরাজয়ের পর এই শান্তি ক্রমশ বিঘ্নিত হতে শুরু করে। প্যালেস্টেনীয় জাতিসত্তার আন্দোলনের এই পর্বের অন্যতম রূপকার হজ আমিন আল হুসেইনি প্যালেস্টেনীয় আরব দের নিজস্ব দেশের দাবিকে সামনে নিয়ে আসেন। এই সময়েই ইউরোপে ফ্যাসিস্টদের ইহুদি বিতাড়ন ও নিপীড়নের অধ্যায় শুরু হলে তারা প্যালেস্টাইনে চলে আসতে থাকেন। প্যালেস্টাইনে বাড়তে থাকা ইজরাইলি জনসংখ্যার চাপের প্রেক্ষিতে আরব প্যালেস্টেনীয়দের নিজেদের দেশের দাবি সঙ্কটজনক হয়ে উঠছে বিবেচনা করে আমিন হুসেইনি ইহুদি জাতিসত্তার আন্দোলনকে আরব প্যালেস্টেনীয় জাতিসত্তার আন্দোলনের প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেন। বিভিন্ন আরব দেশে আরব প্যালেস্টেনীয় জাতিসত্তার আন্দোলন এর সমর্থন তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই প্যালেস্টানীয় ইহুদি ও প্যালেস্টেনীয় আরবদের মধ্যে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়।

ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জুড়ে জার্মানিসহ নাৎসী ও ফ্যাসিস্টদের দ্বারা বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক ইহুদি বিতাড়ন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পরই ইউরোপ এর নানাদেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের পুনর্বাসনের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্যালেস্টাইনকে তিনভাগ করার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন, যার একটি হবে আরব রাষ্ট্র, একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও আলাদা অঞ্চল হিসেবে থাকবে জেরুজালেম, যে ঐতিহাসিক শহর ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম – এই তিন ধর্মেরই অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান। এই ঘোষণার পরদিন থেকেই আরব ও ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।

ইসরাইলের বর্তমান আগ্রাসী ভূমিকা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ভাবিয়ে তুললেও এই রাষ্ট্রটির জন্ম-ইতিহাস দেখলে অবাক হতে হয়। ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মিত্র আমেরিকা কিন্তু ইসরাইলের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। ব্রিটিশরা ইসরাইল ছাড়ার দুদিন আগেও (মানে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণার দুদিন আগে) আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং স্টেট সেক্রেটারি জর্জ মার্শাল ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। ইসরাইলকে মেনে নিতে চাইছিলেন না মার্শাল, কারণ উনি জানিয়েছিলেন, ইসরাইলের জন্ম হলে অশান্ত হবে মধ্য প্রাচ্য। যুদ্ধ হবেই।

এমন অবস্থায় পালেস্টাইনে ব্রিটিশদের আর দুদিন বাকি আছে (১৪ ই মে, ১৯৪৮)-বেন গ্রুন ট্রুম্যানের কাছে দূত পাঠালেন ইসরাইলের স্বীকৃতির জন্য। ট্রুম্যান জিউ ভোটব্যাঙ্কের জন্য ইসরাইলের স্বীকৃতি দিতে চাইলেন। মার্শাল এসব শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ট্রুম্যানের কাছে জানতে চাইলেন, আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ তিনি চাইছেন কি না। ট্রুম্যান এসব কিছু শুনলেন না-আমেরিকা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে বলে জানিয়ে দেয়। সবার আগে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ানসহ সব কমুনিস্ট দেশ। শুধু তাই নয়, প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, যেটাতে হারলে ইসরাইল পটল তুলত, সেই যুদ্ধে ইসরাইলকে অস্ত্র সাহায্য করে চেকোশ্লোভাকিয়াসহ সোভিয়েত ব্লক। আমেরিকা তখন ইসরাইলের ওপর ‘অবরোধ’ চাপিয়েছিল।

তবে ইসরাইল গঠনের মূল পরিকল্পনাকারী হচ্ছে ইংল্যান্ড এবং ওখানকার জায়নিস্ট লবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের যেসব অংশ অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত তা ব্রিটিশদের করায়ত্তে আসে। তার মধ্যে একটা ছিল ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন। ১৮৯৭ সাল থেকেই ইহুদিরা চেয়েছিলেন নিজেদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। তখন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়তা করবে। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে। এতেই সেই কন্ট্রোভার্শিয়াল ‘ন্যাশানাল হোম ফর জুয়িশ পিপলের’ কথা আছে।

১৯৪৮ অনেক পরের কথা। এর মাঝে দফায় দফায় বড় সংখ্যায় জুয়িশ মাইগ্রেশান হয়েছে প্যালেস্টাইনে, ইউরোপের বিভিন্ন অংশ থেকে। এতে ঐ অঞ্চলের ডেমোগ্রাফি বদলেছে, এবং ডিপসিটেড আরব-জুয়িশ টেনশানের সৃষ্টি হয়েছে। হিটলার জার্মানি থেকে এই মাইগ্রেশান এনকারেজ করেছিলেন, জায়নিস্ট ফেডারেশান অফ জার্মানির সঙ্গে  হাভারা এগ্রিমেন্ট করে। এতে কথা হয়েছিল ইহুদিরা যদি জার্মানিতে তাদের সব সম্পত্তি ছেড়ে প্যালেস্টাইনে চলে যায়, তার পরিবর্তে তারা ঐসব জিনিষের রিপ্লেসমেন্ট ফ্রিতে পেয়ে যাবে প্যালেস্টাইনে বসে, অ্যাজ জার্মান এক্সপোর্ট গুড্‌স। ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য কে আসলে দায়ী, এই আলোচনায় এই উল্লিখিত ভূমিকাটা বাদ দিলে আসল ব্যাপারটাই হারিয়ে যায়। এর পর ভলগা-যমুনায় বহু জল গড়িয়েছে। ১৯৪৮-এ দুই যূযূধান পক্ষ (ইসরাইল ও বৃটিশ) এখন এক বিছানায় শোয়। জিওপলিটিক্সের গতি মেসি-নেইমারের ডজের মতই চপল। এই ডানদিক তো এই বাঁদিক। কেউ কারো স্থায়ী শত্রু নয়, কেউ কারো স্থায়ী বন্ধু নয়। যে আমেরিকা একদিন বৃটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছিল, আজ তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে অন্য দেশে বোমা ফেলে।

এটা স্পষ্ট আরব প্যালিস্টেনীয় জাতিসত্তার পূর্ণ মর্যাদা ছাড়া এই চলমান যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের কোনও স্থায়ী সমাধান থাকতে পারে না। ইসরাইল মার্কিন ন্যাটো অক্ষ কিছুতেই স্বাধীন ভূখণ্ড ও জাতিসংঘে সদস্যপদসহ আরব প্যালেস্টেনীয়দের দীর্ঘকালীন ন্যায্য দাবিকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এই প্রত্যাখ্যানই নানা জঙ্গি আক্রমণের দিকে প্যালেস্টেনীয় জাতিসত্তার আন্দোলনকে ঠেলে দেয় ও তাকে অজুহাত করে ইসরাইল ন্যাটো মার্কিন অক্ষের সমর্থনে পালটা হামলা চালায়। বস্তুতপক্ষে ইসরাইলের মধ্য দিয়ে আরব দুনিয়ায় মার্কিন অক্ষ নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার কৌশল হিসেবেই ইসরাইল প্যালেস্টাইন সংঘর্ষকে জিইয়ে রেখেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিনের স্থিতাবস্থা ভেঙে জেরুজালেমকে ইজরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান পশ্চিম এশিয়ার ছাইচাপা আগুন জেগে ওঠার অশনি সঙ্কেত৷ তেল আবিব থেকে নাকি জেরুজালেমে সরে আসছে মার্কিন দূতাবাসও৷ যার তীব্র বিরোধিতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলে৷ আশঙ্কা, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে শান্তি প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারে৷ রক্তক্ষয়ের নয়া পর্বের সূচনা হতে পারে এই এলাকায়! যুদ্ধবাজ স্বার্থান্ধ ‘উন্মাদ’দের কারণে মানবজাতিকে আর কতবার রক্তগঙ্গায় ভাসতে হবে, এটাই প্রশ্ন! 

চিররঞ্জন সরকার : লেখক, কলামিস্ট।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn