জিয়াউল হক মুক্তা*

একটি ফেইসবুক লাইভ সিরিজ যার নাম— যাহা বলিবো সত্য বলিবো। তার (১৬ মে ২০২১) ১৬তম পর্বের লাইভে উপস্থিত ছিলেন জাসদ কেন্দ্রীয় উপদেষ্টমণ্ডলির সদস্য ও বর্ষীয়ান বিপ্লবী আ ত ম সালেহ। সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত শুনলাম তাঁর বক্তব্য। দু’ঘণ্টা ধরে তিনি অনেক বিষয়ে কথা বলেছেন; স্থানীয়-জাতীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে বাংলার লোক-সংস্কৃতি ও নন্দন-সংস্কৃতি পর্যন্ত।

তাঁর বয়স যে খুব বেশি হয়েছে তা নয়, মাত্র ৭৬। সম্ভবত বিবিধ অসুস্থতার কারণে তাঁকে কিছুটা বয়স্ক দেখায়। লাইভের একদম শেষে তিনি বলেছেন যে তিনি এখন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেছেন, তিনি এখন নির্বিঘ্ন-মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন; আর মারা যাবার আগে তিনি কাউকে কষ্ট দিতে চান না ও কারোর বোঝা হতে চান না। মৃত্যু নিয়ে তাঁর উপলব্ধি খুব সহজ ও সাবলীল। তিনি মনে করেন যে মৃত্যুর পর তাঁর দেহ পঁচে গলে মাটিতে মিশে যাবে; এটাই বাস্তবতা, এটাই সত্য। এর পর কোন পুনরুত্থান থাকলে থাকুক, না থাকলে না থাকুক— এ নিয়ে তাঁর কোন মাথাব্যথা নেই। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান একজন বর্ষীয়ান নাগরিক হিসেবে এখনও তিনি মৃত্যুকে দেখেন খুব নির্মোহভাবে— কোন কথিত ঐশ্বরিক ভয়-ভীতি বা পরকাল-ভাবনা তাঁকে আলোড়িত করেনা মোটেই— এটা সত্যি সত্যি তাঁর হৃদমাঝারে অন্তঃশীল অত্যন্ত প্রমিত এক বৌদ্ধিক ও দার্শনিক বোঝাপড়ার বহিঃপ্রকাশ। আমি মুগ্ধ হয়েছি। এমন স্বচ্ছ বোঝাপড়া বর্তমান বাংলাদেশের খুব কম লোকের আছে; এমনকি বাম-সমাজতন্ত্রী-কমিউনিস্টদের মধ্যেও তা দৃশ্যমান নয়। তাঁর এ মহতি মানসিক শক্তিময়তার জন্য তাঁর প্রতি আনত হই নিত্য।

তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলেছেন, বাঙালির ধর্ম-টর্ম নাই। আগে বাঙালি; পরে তথাকথিত মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পরিচয়। এ বিবৃতি তাঁর অসমসাহসী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ— বিশেষত দেশের সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ধর্মান্ধ সাংস্কৃতিক-সাম্প্রদায়িকতার সর্বব্যাপী আগ্রাসনের কালে।

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক বিদ্যমানতার প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ ভীষণ। তিনি মনে করেন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া এ পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না। তাঁর এ কথার সূত্র ধরে বলি— তাঁর দল জাসদ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে একটি চতুর্মাত্রিক আন্দোলনের কথা বলছে— যার [১] প্রথমে রয়েছে চলমান সাম্প্রদায়িকতা-যুদ্ধাপরাধ-জঙ্গিবাদ-তেঁতুলতত্ত্ববিরোধী আন্দোলন; আর এ আন্দোলনের ধারায় [২] এখনকার অগ্রাধিকার দুর্নীতি-দলবাজি-দলীয়করণ-সন্ত্রাস-নির্যাতন-নিপীড়ন-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আর [৩] ভেদ-বিভেদ-অসমতা-বৈষমম্যের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন। এ ত্রিবিধ আন্দোলনের অনিবার্য অনুসঙ্গ হিসেবে থাকতে হবে— [৪] একটি সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

প্রথমটি নিয়ে গত প্রায় দুই দশক ধরে বারবার দলের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-নীতি-কৌশল আলোচনা করার পরও এখনও এমনকি অনেক নেতাকর্মীদের বক্তব্যে তা যথাযথভাবে শ্রুত নয়— তারা অনেকটা নেতিবাচকতার ও কিছুটা ইতিবাচকতার পরিবেশ-প্রেক্ষাপট-প্রচারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আছেন খুব বেশি।

দ্বিতীয়টির অনুধাবন দলে সহজ ও স্বচ্ছ, কিন্তু এ নিয়ে দলের ভেতরে নীতির চেয়ে [ঐক্যের] কৌশলের প্রাধান্য বেশি; যদিও দুর্নীতি-দমন ও সুশাসন দমন বিষয়ে দল মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে ১৯৭৪ সালে এককভাবে ও ১৯৮৮-১৯৮৯ সালে ৫ দলীয় জোটগতভাবে। ১৯৭৪ সালে দল এ আন্দোলন এগিয়ে নিতে পারেনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাসদের ওপর ভয়াবহ প্রশাসনিক আক্রমণের কারণে; আর ১৯৮৮-১৯৮৯ সালে এ আন্দোলন একীভূত হয়ে গিয়েছিল ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বরের অভ্যুত্থানপ্রায় আন্দোলনের দুর্বলতা কাটিয়ে ১৯৯০ সালে শক্তিশালী হয়ে ওঠার কালে। আজ ২০২১ সালে আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যের রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব চর্চার [ঐক্য-সংগ্রাম-ঐক্য] মধ্য দিয়ে বিকশিত করতে হবে এ আন্দোলন। দলে এ বিষয়ে আলোচনার যথাসময় এখনই; এবং অতি সম্প্রতি তা সূচিতও হয়েছে।

তৃতীয়টি নিয়ে দলে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক অনুধাবন ও অনুশীলন নেই; অপরাপর বাম-সমাজতন্ত্রী-কমিউনিস্টদের মতো সাধারণ আবেগের বশবর্তী হয়ে দলের নেতা-কর্মীগণ সমাজতন্ত্রের ভক্ত হয়ে আছেন। এক্ষেত্রে আলোচনার জন্য জাসদের রয়েছে ঐতিহাসিক সুবিধা— জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনার ধারায় গণপ্রজাতন্ত্রের নিশ্চিতকরণে সমাজতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতার পক্ষাবলম্বনের ও মাস্কোভাইট-পিকিঙাইট ধারা থেকে দূরে থাকার অভিজ্ঞতা। তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রাযুক্তিক বিকাশ ও প্রাসঙ্গিক ডিসকোর্সের আলোচনা-পর্যালোচনা থেকে জাসদের পক্ষেই সম্ভব প্রমিত সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির নীতি-কৌশলগত দিক-নির্দেশনা প্রণয়ন করা।

আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিয়ে বলতে গেলে বলা যায় যে দেশের বাম-ডান রাজনৈতিক ঘরানাগুলোর মতো করে আমাদের দলেরও প্রায় সকলে সংস্কৃত-সংস্কৃতি-সাংস্কৃতিক শব্দত্রয়ী নিয়ে ন্যূনতম সাধারণ জ্ঞান নেই; সংস্কৃতি, লোক-সংস্কৃতি ও নন্দন-সংস্কৃতির পার্থক্য বোঝার ক্ষমতাও নেই। এসব সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করে তা উৎরানোর মধ্যে দিয়ে আমাদের শুরু করতে হবে আগামীর পথচলা। এবং সেক্ষেত্রে আ ত ম সালেহ-এর মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব-নেতৃত্বের কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে।

আ ত ম সালেহ-এর সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না; তবে পেশাগত কারণে ২০০২ সাল থেকে আমার সুনামগঞ্জ যাওয়া-আসা; পেশাগত দায়িত্বের ফাঁকে রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের সাথে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ-কথাবার্তা হতো। তখন শুনেছিলাম সুনামগঞ্জের দু’জন কীর্তিমান— জাসদের আ তম সালেহ ও কমিউনিস্ট পার্টির বরুণ রায়— ব্যক্তিত্ব-নেতৃত্ব ও তাঁদের অভিজ্ঞতা-আন্দোলন-অবদানের কথা। গত দশকের প্রথমার্ধে আ ত ম সালেহ-এর সাথে আমার প্রথম কথা হয়। তখন— পূর্বতন পাঠ-অভিজ্ঞতার ধারায় আমি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমে মজে আছি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন শুনি অখণ্ড মনযোগে। সে সময় আমার মনে হলো শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের লেখ্যরূপের বিকাশের সাথে বাংলা ভাষার বিকাশের একটা যোগসূত্র আছে, একই সাথে বাঙালির মানস-গঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রারম্ভিকতার সাথেও একটা যোগসূত্রও আছে। সেটা হলো: পাঁচ হাজার বছর আগের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের যুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা শকুনির বিপরীতে পাণ্ডবদের উপদেষ্টা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। চিরায়ত সনাতনীবোধধারীদের বা হিন্দু ধর্মানুসারীদের পূজনীয় সমর বিশারদ শ্রীকৃষ্ণকে বাঙালি পাল্টে দিলেন প্রেমিক হিসেবে, কোথাকার কোন শ্রীরাধাকে সামনে এনে। পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ ও জীবাত্মা শ্রীরাধার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক পরে পরিণত হলো মানব প্রেমে; আরও পরে এ প্রেম পরিণত হলো মানুষি-বৈষম্য-বিরোধীতার মূলসূত্রে; আর আরও পরে জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষি-সাম্যের বাঙালি জাতীয়তাবাদের উষ্ণপ্রস্রবনে। আ ত ম সালেহ-এর সাথে প্রথম আলোচনার শেষ দিকে আমি বলেছিলাম আমার কৃষ্ণকীর্তনের প্রতি আগ্রহের কথা। তিনি আমাকে বলেছিলেন, কীর্তন শুনছো? এই একটা কাজের কাজ করছো। চালিয়ে যাও। তাঁর প্রেরণা আমাকে সাহস যুগিয়েছিল।

আলোচ্য ফেইসবুক লাইভে আ ত ম সালেহ তার বক্তব্যে বারবার তাঁর এলাকার তিনজন মহান ব্যক্তিত্বের চিন্তাধারার ওপর জোর দিয়েছেন— দেওয়ান হাসন রাজা, রাধারমন দত্ত ও শাহ আব্দুল করিম। বিশেষত শেষের দু’জনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বারবার প্রচণ্ড আবেগাপ্লুত ও অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন। তিনি মনে করেন যে রাধারমন দত্ত ও শাহ আব্দুল করিমের মতো করে মহাত্মা লালনকেও আমাদের ধারণ ও যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাঁর এ বক্তব্যের সাথে আমি পুরোপুরি একমত। নিঃসন্দেহে রাধারমন দত্ত ও শাহ আব্দুল করিম আমাদের জাতীয় মানস গঠনের দু’জন কীর্তিমান— বিশেষত নন্দন-সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের বাঙালি জাতির দার্শনিকবোধের বিকাশে।

রাধারমন দত্ত ও শাহ আব্দুল করিম নিয়ে তিনি নিজে এতটাই স্পর্শকাতর যে— ফেইসবুক লাইভ থেকে জানা যায়— তিনি নিজ মেয়েকে বলেছেন যে রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুলগীতি গেয়ে তার কিছু দেবার নেই, তার ফিরোজা-বন্যা হবার দরকার নেই; তার উচিত তাদের বসতির মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের রাধারমন দত্ত ও শাহ আব্দুল করিমের গান অনুধাবন করা ও গাওয়া।

শেষের একটু আগে আগে তিনি লুঙ্গি পরিধান বিষয়ে বলেছেন। প্রথমে বলেছেন, আই ফিল কমফোর্ট। সাথে বলেছেন, এতে একটু আলাদা আলাদা লাগে, বৈরাগী বৈরাগী লাগে। তাঁর এ কথা থেকে ধারণা করা যায়, সংসারী তাঁর ভেতরে আসলে এক বৈরাগী/সন্যাসীর বাস। বৈরাগ্য ও সন্যাসব্রত তিনি পছন্দ করেন; তাঁর বৈরাগ্য ও সন্যাসব্রত এমন এক ধরনের স্টেট অব মেন্টাল অ্যাফেয়ার্স— যা তাঁকে কর্মবিমূখ করে না বা রাজনৈতিক কর্তব্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়না। তাঁর এ স্টেট অফ মেন্টাল অ্যাফেয়ার্সকে বলা যায়— কোন প্রত্যাশা থেকে নয়, বরং প্রত্যাশাহীন কর্তব্যবোধ থেকে নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালন করা। অনেকেই বিষয়টা বুঝবেন না; তারা জানেন না এমনকি শহর-নগর-বন্দরের ইট-কংক্রিটজগতেও বসবাস করেন কতো বাউল! তাঁদের শরীর থাকে ঘরে, আর হৃদয় ঘোরে বাংলার পথে-মাঠে-ঘাটে ও গাছের তলায়।

জাসদ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে তিনি জাসদ রাজনীতির মৌলঘরানার কেউ নন, জাসদে তিনি পরে এসেছেন; আগে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। যা তিনি স্পষ্ট করেননি, তা হলো, তিনি পিকিঙাইট ছাত্র ইউনিয়ন করতেন— ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ। সিরাজ সিকদারের কথা তিনি বলেছেন; তিনি মাও সেতুঙ ল্যাবরেটরির সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি আফম মাহবুবুল হক ও ড. আফতাব আহমেদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রশংসা করেছেন; কিন্তু জাসদ রাজনীতিতে তাকে আক্ষরিক অর্থেই হাতে ধরে টেনে এনেছেন হাসানুল হক ইনু— এটা তিনি নিজেই বলেছেন। এটা ১৯৮৯ সালের ঘটনা। সামরিক স্বৈশাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চ্যাম্পিয়ন ও মৌলিক অনুঘটক জাসদের ভূমিকার প্রতি তিনি সশ্রদ্ধ ছিলেন। তবে ধারণা করি সময়াভাবে তিনি যেটা বলতে পারেননি যে— তাঁর ছোট ভাই আতম মিজবাহ, রুহুল আমিন তুহিন, পরবর্তীকালের ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুল্লাহিল কাইয়ুম ও জাসদের সে সময়কার সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনুর সক্রিয় উদ্যোগে আ ত ম সালেহ জাসদ রাজনীতিতে যোগদান করেন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি সুনামগঞ্জ জাসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালের জাতীয় কাউন্সিলে তিনি কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলির সদস্য নির্বাচিত হন।

তাঁর সাক্ষাকারের সাথে প্রাসঙ্গিক না হলেও জাসদের ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে সুনামগঞ্জ জাসদকে একটি কেইস স্টাডি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ১৯৮০ সালে সুনামগঞ্জের জাসদ ও ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর ৯০% চলে যান বাসদে। বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন তুহিনসহ বিভিন্ন স্কুল কমিটি ছাত্রলীগের সদস্যরা ১৯৮১ সালে এসএসসি পাশ করে জাসদ রাজনীতিকে গোছানো শুরু করেন; স্কুল কমিটিগুলোর ৮০% জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগে ও ২০% বাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগে যান। এ সময় জাসদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে সুনামগঞ্জের জাসদ রাজনীতির পুনরুত্থানে বিশেষ ভূমিকা রাখেন— বিশেষত ছাত্রলীগকে প্রতিষ্ঠা করার ধারায়। ১৯৮১ সালে এসএসসি পাশ করা ছাত্রলীগ সদস্যদের দিয়ে ১৯৮৩ সালে সুনামগঞ্জ সদরের কমিটি গঠনের মাধ্যমে শুভ সূচনা বিস্তৃত হয়েছিল বাসদে ও আসম আব্দুর রবের সাথে চলে যাওয়া নেতৃত্বের কাউকে কাউকে ফিরিয়ে আনায় ও অন্যদের নিষ্ক্রিয়করণ পর্যন্ত। মাহমুদুর রহমান মান্নাকে তারা ক্রমে বর্জন করেন; তারা আসম আবদুর রবকে পরিত্যাগ করেন এ বলে যে তার সাথে রাজনীতি করা যায়না। তাহলে এখানে দেখা যাচ্ছে স্কুল পর্যায়ে ছাত্রলীগ গঠন ও গণআন্দোলনে নিবেদিত অংশগ্রহণ সুনামগঞ্জে জাসদ রাজনীতির পুনরুত্থানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

এ সময়ের একটি বিশেষ ঘটনার কথা জানিয়েছেন রুহুল আমিন তুহিন। ১৯৮৯ সালেও ঘরের ভেতরে আয়োজিত জাসদের কর্মীসভায় হাসানুল হক ইনুর বক্তব্য শোনার জন্য বাইরের রাস্তাঘাটসব বন্ধ হয়ে যেত রবাহুত জনগণসমাবেশে। ১৯৯১ সালে জাসদ যখন বিগত নির্বাচনী পরাজয়ে অনেকটা হতবিহ্বল— তখন সুনামগঞ্জ সদরে আয়োজিত জনসভার সূচনায় মুষলবৃষ্টি শুরু হলে জাসদ জনসভা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক নেতা সকলের শ্রদ্ধেয় বরুণ রায় তখন হাসানুল হক ইনুকে বলেন, “ইনু, বৃষ্টি হয়েছে তো কী হয়েছে। লোকজন আছে, তুমি কথা বলো। আমরা সুনামগঞ্জের লোহজন তোমার কথা শুনি।” এরপর হাসানুল হক ইনু একটি ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিছাঁটে ভিজতে ভিজতে দেড় ঘণ্টা ধরে একটি বক্তব্য দেন। সাত হাজার মানুষ মুষলবৃষ্টিতে হাসানুল হক ইনুর বক্তব্য শোনেন। এ জনসভার অভিজ্ঞতা থেকে জাসদ পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং দলের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল মউজদিন দলীয়ভাবে পৌরসভা নির্বাচন করে বিজয়ী হন।

জাসদের তখনকার সভাপতি আ ত ম সালেহ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধ ও জাসদবিরোধী আক্রমণের কালে আ ত ম সালেহকে দেশের বাইরে থাকতে হয়। ১৯৮২ সালে দেশে ফেরার পর তিনি সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠনে নন্দন-সংস্কৃতির আন্দোলন পরিচালনা করেন। নাটক ও দরাজ আবৃত্তি ইত্যাদিতে অংশগ্রহণও করেন। এ সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সংযুক্ত থেকে জাসদ রাজনীতিকে পর্যবেক্ষণের ধারাতেই তিনি জাসদের দলীয় কাঠামোতে যুক্ত হন। একজন পরিশীলিত নাগরিক হিসেবে তিনি সকলের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জন করেন। সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা-ভালোবাসাকে এখনও তিনি তাঁর মাথার মুকুট করে রেখেছেন। জনগণের ভালোবাসা তিনি ভোলেননি।

শেষ দিকে বলি— যদিও বিষয়টি সাক্ষাৎকারে আসেনি— কিন্তু আমি জানি যে তিনি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলো সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। তাঁর এ ধারণা এখনও কমিউনিস্ট চিন্তাধারার অসারতা দ্বারা প্রভাবিত। বিশ শতকের চতুর্থ খণ্ডাংশ থেকে সমসাময়িক কালে এসব বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকগুলোই— এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের সহযোগী হয়েছে— এমনকি একচেটিয়া ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর সাধারণ নাগরিকদের নিয়মিত অর্থায়নে এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে সহযোগিতা করেছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলোর কার্যক্রম বিষয়ক এসব তথ্যের ঘাটতিই মূলত তাঁর এ অবস্থানের কারণ। সে যাক।

সামগ্রিকভাবে বলা যায় আতম সালেহ আমাদের পূর্বপ্রজন্মের এমন একজন, যাঁর কাছ থেকে আমাদের শেখার রয়েছে অনেক কিছু। শুধু তাঁর কাছ থেকেই নয়, আমাদের শেখার রয়েছে তাঁর মতো অন্যান্যদের কাছ থেকেও। আমাদের সমাজব্যবস্থার পশ্চাদপদতার একটা দিক হলো যে পূর্বসূরি বয়স্ক-অভিজ্ঞ নাগরিকদের কাছ থেকে তরুণ ও পরপ্রজন্মের শেখার/জানার কোন আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই। আবার এমনকি, তাঁরা যেহেতু বয়স ও স্মৃতিনির্ভরতার জন্য কিছুটা/অনেকটা ধীর— নবীন/তরুণদেরও ধৈর্য ও একনিষ্ঠতা নেই তাঁদেরকে শোনার। কর্পোরেট জগতের লিডার ও ম্যানেজারদের পাফরম্যান্সের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হলো— লিসেনিং টু আদার্স। রাজনীতিতেও তা অবশ্য প্রয়োজনীয় একটি গুণ; এবং পূর্বসূরিদের শোনার ক্ষেত্রে এ গুণ আরও অত্যাবশ্যক।

জাসদের উপদেষ্টামণ্ডলি ও স্থায়ী কমিটিতে— এমনকি কোন ধরনের কাঠামোর বাইরেও— এমন অনেকে রয়েছেন যাঁদের কাছ থেকে আমাদের শোনা উচিত। প্রচুর শোনা উচিত। এতে লাভ বই ক্ষতি নেই। প্রিয় সালেহ ভাই দীর্ঘজীবী হোন।

[এ রচনায় ব্যবহারের জন্য কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন জাসদ স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম ও সুনামগঞ্জ জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন তুহিন। অণীশ তালুকদার বাপ্পু’কে কেবল ধন্যবাদ জানানোই যথেষ্ট নয়; তার লাইভ অনুষ্ঠানটিই এ রচনার মূল অনুপ্রেরণা; সেজন্য তার কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।]-লেখক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক।

*মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn