ফেসবুকে একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে ভোলা জেলায় একটি হিন্দু পরিবার গত দুই সপ্তাহ ধরে অনেকটা গৃহবন্দি হয়ে আছে। ওই পরিবারের প্রধান গৌরাঙ্গ চন্দ্র দে ঘটনার পর থেকেই কারাগারে আছেন। বিষয়টি নিয়ে সেখানে একদিকে যেমন উত্তেজনা বিরাজ করছে, অন্যদিকে স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যে রয়েছে আতঙ্ক। এ ঘটনা তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এছাড়া এলাকায় যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ওই এলাকায় সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

ভোলায় এ ঘটনার সূত্রপাত ১৫ সেপ্টেম্বর। ওই দিন জয়রাম ও গৌরাঙ্গ নামে আইডির মধ্যে মেসেঞ্জার কথোপকথনের একটি স্ক্রিনশট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে অবমাননাকর কিছু বক্তব্য থাকায় বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিতর্কিত ওই পোস্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ ডায়েরি করেন গৌরাঙ্গ চন্দ্র দে। জেলা সদরে এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। গৌরাঙ্গ চন্দ্র দে ভোলা সদরে প্রভাবশালী একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা। তিনি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে সক্রিয় এবং ভোলা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদেরও সভাপতি।

ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ

গৌরাঙ্গ চন্দ্রের দ্রুত মুক্তি দাবি করে পরিবার ও হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে গৌরাঙ্গ চন্দ্রকে ফাঁসানো হয়েছে। গৌরাঙ্গ নামের অ্যাকাউন্টটি অল্পকিছুদিন আগে খোলা হয়েছিল। তবে ঘটনার পর থেকে ওই অ্যাকাউন্ট সচল নেই। গৌরাঙ্গের স্ত্রী রিনা রাণী দে বলেন, এমন কাজ তিনি করেননি। এ ঘটনায় পুরো পরিবার বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। “এরকম থাকার থেকে না থাকা ভালো। অনেক কষ্টের জীবন। মেয়েটা অসুস্থ পড়ে রইছে ঘরে, মেয়ে নিয়ে থাকি। স্বামীর এই অবস্থা।”

প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বের হতে নিষেধ করা হয়েছে জানিয়ে রিনা রাণী দে বলেন কতদিন এভাবে থাকতে হবে সেটিও অনিশ্চিত। গত দুই সপ্তাহ ধরে তারা কেউ বাড়ির বাইরে বের হন না। “এমনকি রাস্তায়ও বের হই না। আমাগো সামনে রাস্তায়ও বের হই না। ঘরেই থাকি”। ঘটনার পর থেকে বাজারে গৌরাঙ্গের দুটি দোকানও বন্ধ রয়েছে। গৌরাঙ্গের একটি দোকানে বসতেন তার ছোট ভাই রাজকুমার দে। তিনি বলেন, “খুব আতঙ্কে আছি। আমরা কেউই বাইরে যাওয়ার মতো চিন্তাও করতে পারি না। যে বাইরে যাবো, ঘোরাফেরা করবো। বাজারে যাব, দোকান খুলবো এই সাহস পাচ্ছি না আমরা”।

ভোলা সদরে গৌরাঙ্গ চন্দ্র দে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটায় স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ভোলায় এর আগেও ফেইসবুকে বিতর্কিত পোস্টের জেরে হামলা-ভাঙ্গচুরের কথা উল্লেখ করে এলাকার প্রতিবেশী এক নারী বলছিলেন, “বিগত দিনে যারা করছে তাদের শাস্তি যদি জনসমক্ষে হতো তাহলে যারা করে এ ধরনের ঘটনা তারা সাহস পেত না”। আরেকজনের প্রশ্ন “পুলিশ কতদিন আমাদের পাহারা দেবে।” ভয়-আতঙ্কের দিকটি তুলে ধরে স্থানীয় মন্দিরের সেবায়েত বলেন, “শুনি মিছিল করবে, এই করবে, ওই করবে এটাই চিন্তা। আমরাতো সংখ্যালঘু।”

এলাকার শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক নেপাল চন্দ্র দে বলেন,” গৌরাঙ্গ চন্দ্র দে সক্রিয় রাজনীতি করে, বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত, তাকে ঘিরে কেন? এটাতো প্রশ্নই জাগে। যে যদি ষড়যন্ত্রই না থাকে, তাহলে তাকে ঘিরে কেন এটা।” অন্যদিকে ভোলায় গৌরাঙ্গ চন্দ্রের শাস্তির দাবি সোচ্চার হয়েছে ইসলামপন্থী বিভিন্ন সংগঠন। নানা কর্মসূচী দিয়ে তারা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেছে। জেলায় বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন এবং স্মারকলিপি দিয়ে ধর্মীয় অবমাননার কঠোর শাস্তির দাবিতে একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফেসবুকে কটূক্তিকারীর শাস্তির দাবিতে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে একটি ভোলা জেলা মুসলিম ঐক্য পরিষদ।

সংগঠনটির সম্পাদক মাওলানা মোহাম্মদ মোবাশ্বিরুল হক নাইম বলেন, ভোলায় গত দুই বছরের মধ্যে তিনটি অবমাননার ঘটনা ঘটেছে। তারা চান প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। “দেখেন ধর্মের ব্যাপারে যদি কোনো কিছু হয় তাহলে সেটা কেউ মেনে নেবে না। সেটার তারা প্রতিবাদ করবে। এবং প্রতিবাদ করে তারা কী বলছে? তারা বলছে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করুন, আইনের আওতায় আনুন। প্রতিবাদের ভাষা এটা, চাচ্ছে এটা, হওয়া দরকারও এটা, তাহলে হচ্ছে না কেন?”

ফেসবুকে ইসলাম অবমাননা: ধর্মীয় নাকি রাজনৈতিক বিষয়
ভোলায় এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে বিধায় বিষয়টি তদন্তে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে তদন্তকাজ সময়সাপেক্ষ বলে জানান ভোলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার। “গৌরাঙ্গ নামের আইডির কোনোকিছু আমরা চাইতেই পারি নাই। কারণ একটা আইডির ডিটেইলস চাইতে গেলে সেখানে লিংকসহ পাঠাতে হয় ফেইসবুক আইডির। আমরা ওইটার লিংক পাইনাই। আমরা জয়রামের লিংক পেয়েছি। আমরা আশাবাদী যে এটাও বের করতে পারবো।”
 ভোলায় উত্তেজনার বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টি যদি থাকে। তারা এটা ঘৃণা জানাবে, প্রতিবাদ করবে স্বাভাবিক। কিন্তু এটা যেন সেই ধর্মীয় পরিধির মধ্যেই থাকে। এটাকে যেন আবার কেউ রাজনৈতিকভাবে কেউ ব্যবহার করতে না পারে। আমি উদ্বিগ্ন এটা নিয়েই”।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn