পিয়াস সরকার –
নাইজেরিয়া থেকে বাংলাদেশে পড়তে এসেছেন ফয়সাল। তিনি ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী। আশা ইউনিভার্সিটিতে  পড়ছেন জিম্বাবুয়ের শিক্ষার্থী ওডোও রাক্সিক। শিকদার মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করছেন নেপালি শিক্ষার্থী অন্তিনিম প্রাচি। শুধু ফয়সাল, রাক্সিক কিংবা প্রাচি নন। প্রতিবছর এমন বহু শিক্ষার্থী তাদের লেখাপড়ার জন্য বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশকে।কিন্তু এ দেশে তারা কেমন আছেন? কেমন কাটছে তাদের দিনকাল? বিদেশি এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে সুখ-কষ্টের নানা স্মৃতি। তবে সবার কথায় প্রধান সমস্যা হিসেবে ফুটে উঠেছে আবাসন। বাংলাদেশে পড়তে আসার স্বপ্ন প্রথমেই ধাক্কা খায় বাসস্থান সমস্যার কাছে। সোমালিয়া, ভারত, মালদ্বীপ, ভুটান, তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরান, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে, নেপাল ও নাইজেরিয়ার ২,২৮২ জন শিক্ষার্থী এ মুহূর্তে দেশের সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা করছেন। এর মধ্যে ১৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন ৩৫৫ জন বিদেশি শিক্ষার্থী। পাশাপাশি ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৪টিতে পড়ছেন ১,৯২৭ জন শিক্ষার্থী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র মতে, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে ৯৮৩ জন বিদেশি শিক্ষার্থী। এর আগে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে এর সংখ্যা ছিল ৮৫০ জন। এসব শিক্ষার্থীকে আবাসন সমস্যার পাশাপাশি ভাষাগত সমস্যাও পড়তে হচ্ছে। এছাড়া খাদ্য এবং যাতায়াতের ক্ষেত্রের নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কেউ কেউ ইভটিজিংকেও মোকাবিলা করার কথা জানিয়েছেন।
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল বলেন, আমাদের বাসা ভাড়া নিতে ভীষণ বেগ পেতে হয়। যদিও পাই, ভাড়া রাখা হয় অনেক বেশি। আবার দিতে হচ্ছে তিন থেকে চার মাসের অগ্রিম ভাড়া। যেখানে সাধারণ ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে রাখা হয় মাত্র এক মাসের অগ্রিম ভাড়া। ফয়সাল বলেন, এক্ষেত্রেও দেয়া হচ্ছে নানা শর্ত। কাজের বুয়ার সমস্যা তো আছেই। ফলে রান্না থেকে শুরু করে সব নিজেকেই করতে হয়।  আশা ইউনিভার্সিটির জিম্বাবুয়ের ছাত্রী ওডোও রাক্সিক বলেন, আমরা ২৫ জন শ্যামলীর একটি বাড়িতে ৪টি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতাম। একটিতে মেয়েরা আর তিনটিতে ছেলেরা। সবাই ছিলাম বিভিন্ন দেশের নাগরিক। আমাদের পাশের ছেলেদের ফ্ল্যাটে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয় তিন শিক্ষার্থী। পুলিশ আসার কারণে সেই রাতেই বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেন বাড়িওয়ালা। ছেলেদের সময় দেন মাত্র তিনদিন আর আমাদের নির্দেশ দেন চলতি মাস পর্যন্ত। ভয়াবহ দিন পার করেছি আমরা। ছেলেরা তিন দিনের মধ্যে বাড়ির ব্যবস্থা করতে না পারায় মেয়েদের ফ্ল্যাটে মালামাল রেখে বাড়ি ছেড়ে দেন। কেউ হোটেলে কেউবা বন্ধুর মেসে থেকে বাড়ি খোঁজা শুরু করেন। অনেক কষ্টে বাড়ি খুঁজে পাই। যারা পড়তে আসি তাদের মাঝে গুটিকয়েক শিক্ষার্থী অন্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। অথচ ফল ভোগ করতে সবাইকে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সোমালিয়ান শিক্ষার্থী ওমর বলেন, আমরা সাধারণত প্যাকেটজাত পণ্য কিনি। কারণ এতে মূল্য লেখা থাকে। এসব সুপার শপই আমাদের ভরসা। সময় স্বল্পতা বা কোনো কারণে যদি খোলা বাজার থেকে এসব কিনতে হয় তখন আমরা ধরে নিই বেশি মূল্যে কিনলাম। ওমর বলেন, ইংরেজি না বোঝার কারণে ক্রেতার সঙ্গে কথা বলার ঝামেলা তো আছেই।
এদিকে উবার, পাঠাও ইত্যাদি সার্ভিস আসায় অনেক খুশি শিকদার মেডিকেল কলেজের নেপালি শিক্ষার্থী অন্তিনিম প্রাচি। তিনি বলেন, আগে কোথাও যাবার প্রয়োজন হলে ভরসা ছিল সিএনজি বা রিকশা। চালকদের গন্তব্য বোঝানো যেমন কঠিন তেমন ইচ্ছামতো ভাড়াও নেয়া হতো বেশি। আবার অনেক চালক ভাষা না বোঝায় আমাদের নিতে চান না।  অন্যদিকে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সোমালিয়ান শিক্ষার্থী বাশির বলেন, আমরা সাধারণত গণপরিবহনে উঠি না। কারণ সাধারণ যাত্রীরা আমাদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে, যা অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।  শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বলেছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় দীর্ঘ জটিলতায় পড়েন তারা। বাড়তি টাকাও গুনতে হয় অনেককে।
সোমালিয়ান ছাত্রী আরশিদা ইমরা সোয়াদ বলেন, আমরা সবাই ইংরেজিতে খুব একটা পারদর্শী না। বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলতে হয় ইংরেজিতে। যার ফলে প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় কম। তবে তারা খুবই বন্ধুত্ব-প্রবণ ও কোনো প্রয়োজনে সাহায্য করতে পিছপা হন না। আবার অনেক শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গেও কথা বলেন না ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে।  রংপুর প্রাইম মেডিকেল কলেজের শ্রীলঙ্কান শিক্ষার্থী দিমুথ দানুশেকা বলেন, আমি এখানে একমাত্র লঙ্কান শিক্ষার্থী। আমাকে সব সময় ইংরেজিতে কথা বলতে হয়, যা খুব কষ্টকর। নিজের ভাষায় কথা বলার যে তৃপ্তি তা থেকে বঞ্চিত হই সব সময়। ঈদের ছুটিতে প্রায় ফাঁকা হয়ে যায় রাজধানী ঢাকা। আবার সেমিস্টার ব্রেক, পূজার ছুটি, বৌদ্ধ পুর্ণিমা, বড়দিন পরিবার ছাড়া পালন করতে হয় তাদের। আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজের ইরানি ছাত্র হোসেন আল মহিন বলেন, মূলত বিমান ভাড়ার কারণে ঈদের ছুটিতে দেশে যাওয়া হয় না। খুব কষ্ট হয়, হোস্টেলের প্রায় সবাই চলে যায় বাড়িতে। আমরা কয়েকজন মাত্র থাকি ঢাকায়। পরিবার ছাড়া ঈদ করতে খুবই অসহায় লাগে নিজেকে। অন্যদিকে বন্ধুত্বের নমুনা তৈরি করেছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষার্থী কাব্য। তিনি তার ক্লাসের একমাত্র বিদেশি। তারপরও ব্যাপক জনপ্রিয়। সবার সঙ্গে বান্দরবান ভ্রমণেও গিয়েছিলেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি এক সহপাঠীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন নাইজেরিয়ান এক যুবক। এ প্রেমিক জুটি জানান, আমাদের ভবিষ্যৎ কি তা জানি না। তবে সারা জীবন থাকতে চাই একসঙ্গে। নেপালি শিক্ষার্থী নলিনি বলেন, বাংলাদেশ আমার অনেক সুখস্মৃতির সঙ্গী।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn