তসলিমা নাসরিন-

 

একটি সাদা শাড়ি পরা বৃদ্ধা কাঁদছেন। পেছনে বাড়ি ঘর পুড়ছে। ফেসবুকে ছবিটা দেখে আমি ভেবেছিলাম রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পোড়ানোর দৃশ্য, বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনারা, আর অসহায় রোহিঙ্গা বৃদ্ধা সহায় সম্পত্তি সব হারিয়ে কাঁদছেন। এরকমই ভাবতাম, যদি ছবির নিচের লেখাটা না পড়তাম। লেখা ছিল এটি বাংলাদেশের রংপুরের ঘটনা। ১০ হাজার মুসলমান হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাদের  বাড়িঘর লুট করেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে। কারণ কী? টিটু রায় নামের এক লোক নাকি ইসলামের  অবমাননা করেছে ফেসবুকে। ১০ হাজার মুসলমান জড়ো করা কি চাট্টিখানি কথা? শুনেছি হামলাকারীরা নাকি চেয়েছিল হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করে পুড়িয়ে দিতে।  আজকাল এই অপকর্মটি করা বড় সহজ। শুধু গুজব একবার ছড়িয়ে দিলেই হয় যে এ পাড়ার বা এ গ্রামের এক হিন্দু লোক ইসলামের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লিখেছে। ব্যস, উন্মত্ত মুসলমান হাতে দা-বটি-লাঠি আর আগুন হাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কেউ জানতে চাইবে না ইসলামের অবমাননা ঠিক কিভাবে করা হয়েছে, জানতে চাইবে না যে লোক অবমাননা করেছে বলা হচ্ছে সে লোকের ফেসবুক আইডি কী আসল না নকল, জানতে চাইবে  না বাংলাদেশের হিন্দুরা জেনে বুঝে এই ঝুঁকি নেওয়ার সাহস করবে না, তাহলে কি হিন্দু নয়– কোনও মুসলমানই হিন্দুর নামে আইডি খুলে ইসলামের অবমাননা করেছে! রংপুরের গ্রামে এভাবেই হামলা হয়েছে। হামলাকারীরা আগে থেকেই  পরিকল্পনা করেছে, যেরকম করেছিল নাসির নগরে। রসরাজ নামের এক হিন্দু জেলেকে ফেসবুকের পোস্টের জন্য ফাঁসিয়েছিল। ওই ছুতোয় হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল। পরে সত্য ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। রসরাজ ফেসবুকের কিছুই জানে না। ওর নামে ফেসবুকে আইডি খুলে আসলে কোনও এক মুসলমান অপকর্মটি করেছিল, এবং দল গঠন করেছিল কী করে হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করা যায়, কী করে ওদের সব কিছু পুড়িয়ে দেওয়া যায়, কী করে ভয় পাইয়ে দিয়ে দেশ থেকে তাড়ানো যায় ওদের, এবং তারপর কী করে দখল করা যায় হিন্দুদের ভিটেমাটি। রংপুরেও একই চিত্র। টিটু রায় নামের কেউ ওই গ্রামে ৭ বছর যাবত বাস করে না। টিটু রায় দেনার দায়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়ে বহু দূরের শহরে গার্মেন্টসে কাজ করে বেঁচে আছে। টিটু রায় দেয়নি কোনও স্ট্যাটাস, দিয়েছিল খুলনার মওলানা আসাদুল্লাহ হামিদী। মওলানা হামিদীর উদ্দেশ্য ছিল সিলেটের কোনও এক হিন্দু যুবক রাকেশ মন্ডলকে বিপদে ফেলা। মওলানা হামিদীর স্ট্যাটাস শেয়ার করেছিল এমডি টিটু নামের একজন।  এই এমডি টিটুকেই রংপুরের পাগলাপীর এলাকার টিটু রায় ভেবে টিটু রায় এবং তাদের প্রতিবেশীদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। নাসিরনগরের রসরাজের আইডি যেমন একজন মুসলমান তৈরি করেছিল  রসরাজের বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ দিয়ে হিন্দু গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য, ঠিক তেমনি এমডি টিটু নামের আইডিও একই উদ্দেশে  তৈরি করেছে কোনও মুসলমান।

বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের একাংশ দিন দিন চরম হিন্দু-বিদ্বেষী হয়ে উঠছে। তারা অমুসলিমদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে একশ ভাগ মুসলমানের দেশ বানাতে চায় বাংলাদেশকে। ভালো যে হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার আগে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল যে কাজটি কোনও হিন্দুর নয়,  হাবিবুর রহমান নামের এক মুসললমানের। আমি জানি না হাবিবুর রহমান বা তাকে দিয়ে যারা এ কাজটি করিয়েছিল, তাদের আদৌ কোনও শাস্তি হয়েছিল কিনা। আমি আজও অবাক হই সেই হেফাজতি গুন্ডাদের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কেন কোনও ক্ষোভ দেখিনি,  যারা বায়তুল মোকাররমের আশেপাশের দোকানের শত শত কোরআন পুড়িয়ে দিয়েছিল!   ভারতেও দেখেছি বাংলাদেশের হিন্দু -বিদ্বেষী মুসলমানদের মতো গজিয়ে উঠেছে মুসলিম-বিদ্বেষী হিন্দু। তারাও মনে করে– ‘মুসলমানদের কোনও অধিকার নেই ভারতে বাস করার। মুসলমানেরা ভারতবর্ষে ঢুকে হিন্দুদের নির্যাতন করেছে, হিন্দুদের শত সহস্র মন্দির ধ্বংস করেছে। সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হওয়ার কারণ ছিল একটিই, হিন্দুরা ভারতে থাকবে আর মুসলমানের থাকবে পাকিস্তানে। কিন্তু মুসলমানেরা সবাই যায়নি পাকিস্তানে, ভারতে বসে বাচ্চা পয়দা করছে, আর জনসংখ্যা বাড়িয়ে চলছে। সন্ত্রাসী দলে যোগ দিচ্ছে, আর সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে অঢেল সরকারি সুযোগ সুবিধে পেয়ে যাচ্ছে।’ এহেন মুসলিম-বিদ্বেষী হিন্দুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, কোনও মুসলমান গোমাংস খেয়েছে– এই গুজব শুনে রাস্তা ঘাটে হাটে বাজারে ট্রেনে বাসে কোনও মুসলমানকে হাতের কাছে পেলে পিটিয়ে মেরে ফেলছে।

হিংসের চেহারাগুলো সব একরকম। হিংসের ভাষাও এক। আমি যখন হিন্দুদের করভা চৌথের এবং মুসলমানদের বোরখা- হিজাবের বিরুদ্ধে বলি— দু’পক্ষ থেকে যে গালাগালি শুনি তা একই গালি, দু’পক্ষ থেকে আমার দিকে একইরকম ঘৃণা ছুঁড়ে দেওয়া হয়। দেখে মনে হয় এরা সমাজের কোনও পরিবর্তন চায় না। অন্ধকার আর অশিক্ষা এদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমি দু’পক্ষকে, সত্যি বলছি, আলাদা করতে পারি না। তারপরও বলবো, ভারত এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা কমছে, ভারতে সংখ্যালঘুর সংখ্যা বাড়ছে। ভারতের মুসলমানের সংখ্যা গোটা বাংলাদেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ভারতের মুসলমান কট্টর হিন্দু দ্বারা অত্যাচারিত হলেও রাষ্ট্র তাদের  পাশে থাকে। ভারতের আইন হিন্দু মুসলমান সবাইকে সমান চোখে দেখে। বাংলাদেশের হিন্দুরা কট্টর মুসলমান দ্বারা আক্রান্ত হলে রাষ্ট্রের সহায়তা, সরকারের সহানুভূতি পায় না বললেই চলে। হিন্দু সংখ্যা এত কমে গেছে তাদের আর ভোটব্যাংক হিসেবেও গোনা হয় না। ইসলামপন্থী দলের লোকেরা হিন্দুদের শাসিয়ে যায় ভোট দিতে গেলে সর্বনাশ করবে। হিন্দুরা বাংলাদেশে শুধু দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নয়, ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকা বাঙালি জাতি।

মাঝে মাঝে ভাবি বাংলাদেশ সম্পূর্ণ বিধর্মীমুক্ত হয়ে গেলে কি মুসলমানদের কোনও লাভ হবে? বাংলাদেশ কি সৌদি আরবের মতো পবিত্র স্থান হয়ে উঠতে চাইছে! সৌদি আরবে গোপনে গোপনে কী হয়, সেদিন এক সৌদি রাজপুত্রের সাবেক স্ত্রী ফাঁস করলেন, দেদার মেয়ে বিক্রি হয়, দুর্নীতি, মদ্যপান, উলঙ্গ নৃত্য, আর ব্যাভিচারে বুঁদ হয়ে  থাকে সৌদি রাজা এবং রাজপুত্রেরা।  অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। মিয়ানমার সেনা যেভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়িঘর পুড়িয়েছিল, তা দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে বাংলাদেশের মুসলমান। কিন্তু নিজের দেশেই যখন ঘটনাগুলো তারা নিজেরাই ঘটায়? যখন দেশের মানুষের বাড়িঘর  পুড়িয়ে দেয় শুধু তাদের ধর্মটা ভিন্ন বলে? মিয়ানমার সেনাদের যে অপরাধ দেখে বাংলাদেশের মুসলমানেরা কেঁদেছিল, সেই একই অপরাধ তারা নিজেরাই করে তাদের নিজের দেশে। কী পার্থক্য তবে তাদের সঙ্গে বর্বর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর? আমি তো কোনও পার্থক্য দেখি না। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান -মুসলমান কট্টরবাদি সব এক। তারা সমাজকে স্থির রাখতে চায়, অথবা পেছনে ঠেলতে চায়। হিংসে আর ঘৃণাই তাদের সম্বল। কট্টরবাদির বিপক্ষ শক্তিকে রুখে দাঁড়াতে হবে, তা না হলে হিংসে আর ঘৃণার কাছে একদিন হেরে যাবে এতকালের গড়ে তোলা শুভবুদ্ধি,  মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র।   যতবার সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠদের নির্যাতনের ভয়ে নিজের দেশ ছেড়ে পালায়, ততবার নষ্ট হয় দেশ। যে কোনও দেশই। আমার বাংলাদেশ আর কত নষ্ট হবে?

লেখক: কলামিস্ট

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn