কবিতায় মোহাম্মদ সাদিক এবং শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ। শনিবার বিকেলে বাংলা একাডেমির শহীদ মুনির চৌধুরী সভাকক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান পুরস্কার প্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন।  কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনী, নাটক, বিজ্ঞান/প্রযুক্তি/পরিবেশ, শিশুসাহিত্য এই ১০টি শাখায় এবার পুরস্কার পাবেন ১২ গুণীজন। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুণীজনদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন।  বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭ পাওয়া ১২ গুণীজন হলেন কবিতায় মোহাম্মদ সাদিক ও মারুফুল ইসলাম, কথাসাহিত্যে মামুন হোসাইন, প্রবন্ধে অধ্যাপক মাহবুবুল হক, গবেষণায় অধ্যাপক রফিকুল্লাহ খান, অনুবাদে আমিনুর ইসলাম ভূঁইয়া। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যে এ পুরস্কার পাচ্ছেন কামরুল ইসলাম ভূঁইয়া ও সুরমা জাহিদ। ভ্রমণকাহিনীতে পুরস্কার যাচ্ছে শাকুর মজিদের ঘরে। নাটকে মলয় ভৌমিক, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে পুরস্কার পাচ্ছেন মোশতাক আহমেদ এবং শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ।
ড. মোহাম্মদ সাদিক
কবি মোহাম্মদ সাদিক ১৯৫৫ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ধাড়ারগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০১৬ সালের ২ মে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন। এর পূর্বে তিনি  গত ৩ নভেম্বর ২০১৪ থেকে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বর্তমানে তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৭৬ সালে বি.এ.[সম্মান] এবং ১৯৭৭ সালে এম.এ. কবি মোহাম্মদ সাদিক যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৪-৯৫ সালে ‘পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ে পড়াশুনা করেন এবং পরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ‘সিলেটি নাগরী লিপির’ ওপর তাঁর গবেষণার জন্যে ২০০৫ সালে ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।  সিভিল সার্ভিসে বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী কবি সাদিক সরকারের শিক্ষা সচিব ও বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব এ্যাডমিনিস্ট্রেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট [বিয়াম] ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমির পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নজরুল ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভিন্ন ভিন্ন পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সুইডেনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব এবং কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কবি সাদিক বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সক্রিয় রয়েছেন। তিনি বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জীবন-সদস্য। তিনি জাতীয় কবিতা পরিষদ ও বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। মরহুম মোহাম্মদ মবশ্বির আলী এবং মরহুমা মাসতুরা বেগমের একমাত্র পুত্র কবি মোহাম্মদ সাদিক বিবাহিত এবং তাঁর সহধর্মিনী জেসমিন আরা বেগম কুমিল্লা জেলা জজ বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের একজন সিনিয়র সদস্য। পুত্র মোহাম্মদ কাজিম ইবনে সাদিক এবং কন্যা মাসতুরা তাসনিম সুরমাকে নিয়ে তাঁর সংসার।
কবি সাদিকের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাসমূহ হচ্ছে ‘আগুনে রেখেছি হাত’[১৯৮৫], ‘ত্রিকালের স্বরলিপি’ [১৯৮৭], ‘বিনিদ্র বল্লম হাতে সমুদ্রের শব্দ শুনি’ [১৯৯১], ‘কে লইব খবর’[২০১০], ‘নির্বাচিত কবিতা’ [২০০৫], ‘শফাত শাহের লাঠি’ [২০১৭], ‘কবি রাধারমণ দত্ত: সহজিয়ার জটিল জ্যামিতি’ [২০১৭] ইত্যাদি। তিনি নাইজেরিয়ার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক চিনুয়া এচিবি-র বিখ্যাত উপন্যাস ‘ঘড় খড়হমবৎ ধঃ ঊধংব (১৯৬০)’  বাংলায় অনুবাদ করেন ‘নেই আর নীলাকাশ’ নামে এ অনুবাদ উপন্যাসটি ঐতিহ্য থেকে এবং তাঁর পি.এইচ.ডি গবেষণা অভিসন্দর্ভ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। কবি সাদিক যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভূটান, স্পেন, ইটালি, সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।  কবি মোহাম্মদ সাদিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘হাজার বছরের বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় আমি সামান্য একটি বিন্দুমাত্র। আমাদের মহান মরমী কবি সৈয়দ শাহনূর, আফজল শাহ্, রাধারমণ দত্ত, হাসনরাজা, দূর্বিণ শাহ্, শাহ্ আব্দুল করিম, আছদ আলী শাহ্সহ যাঁরা আমাদের শেকড় পর্যায়ে আলোর প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন তাঁদের জন্য পুরস্কারকে উৎসর্গ করছি। একই সঙ্গে বাংলা কবিতায় হাজার বছর ধরে যাঁরা অবিস্মরণীয় অবদান রেখে চলেছেন তাঁদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা।’
ঝর্না দাশ পুরকায়স্থ
এদিকে ঝর্না দাশ পুরকায়স্থ সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চল সুখাইরের জমিদার পরিবারে ১৯৪২ সালে জন্ম। বাবা সুধাংসু শেখর চৌধুরী ও মা নীলিমা চৌধুরীর প্রথম সন্তান। সরকারী এস সি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে মেটিক, ১৯৫৯ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে এইচ এস সি, স্বামীর কর্মস্থল রাজশাহীতে অবস্থানকালে রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেনীতে প্রথম হন ১৯৭৬ সালে। বিএ ক্লাসে ভর্তির কিছুদিনের মধ্যে শৈলেন্দ্র শেখর দাশ পুরকায়স্থের সাথে বিয়ে হয়। পারিবারিক জীবনে তিনি চার সন্তানের জননী।   ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রথম স্বরচিত বাংলা কবিতা পড়ে সম্মাননা লাভ করেন। তাঁর রচিত শিশু সাহিত্য মোট বই বের হয়েছে ৩৬ টি, উপন্যাস ১০ টি, ছোট গল্প ১৫ টি। এজন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন নানা সংগঠন থেকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাজেদুন্নেসা খাতুন চৌধুরী সাহিত্য পদক ১৪০১ বাংলা, বাংলাদেশ জাতীয় সাহিত্য পরিষদ ও সমাজ সেবা পদক ১৯৯৪, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক ১৯৯৬, কমর মুশতারী স্মৃতি পুরস্কার ১৯৯৮, সিলেট লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক ২০০০, আগুনের ফুলকী শিশু উন্নয়ন পুরস্কার (শিশু সাহিত্য) ১৯৯৯, রিআ্যাফ সাহিত্য পুরস্কার ২০০২, আশরাফ সিদ্দিকী ফাউন্ডেশন সাহিত্য পদক ২০০২, ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি গোষ্ঠি গোল্ড মেডেল পদক ২০০৩, কবি সংসদ বাংলাদেশ পদক ২০০৮ ১১.আলোয় ভূবনভরা বিজয় দিবস সম্মাননা পুরস্কার ২০০৪, এম নূরুল কাদির শিশু সাহিত্য পুরস্কার ২০০৬, রাগীব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার ২০০৬, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার ১৩১৫বাংলা, নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার ২০০৯, অগ্রনী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, লেডিস ক্লাবের ৬১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সম্মাননা। এছাড়াও তিনি আজীবন সদস্য বাংলা একাডেমীর, লেখিকা সংঘ বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ লেখক সংঘের। রেডিও টেলিভিশনের মনোনীত গীতিকার তিনি। ভ্রমণ করেছেন ভারত ও জার্মানী।  ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ প্রতিক্রিয়া বলেন, ‘পুরস্কার একটি টনিকের মত, যে পেয়েছে তাকে উৎসাহিত করে, অনুপ্রাণিত করে। মা-বাবার ভালবাসা সবাই পায়, বাংলা একাডেমি থেকে পাওয়া এই সম্মানের অনন্য মর্যাদা রয়েছে। এটি অনেক আনন্দের, আমি এটি সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ বলে মনে করি। কবির ভাষাতেই বলছি, ‘যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন’।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn