যেখানেই জঙ্গি হামলায় নিহতের ঘটনা ঘটত, সেখানেই ছুটে যেতেন স্বামীহারা মুনমুন। সাত মাস ধরেই ‘এ’ লেভেল পাস সন্তানকে (আয়াদ আল হাসান) হন্যে হয়ে খুঁজেছেন সব জায়গায়। ছেলে যে জঙ্গি দলে নাম লিখেছে, সেটা আঁচ করতে পেরেছিলেন ৯ আগস্ট মিরপুরের মনিপুরের বাসায় টেবিলের ওপর ছেলের রেখে যাওয়া চিরকুট দেখেই। চিরকুটে লেখা ছিল- ‘আমরা আমাদের পথ খুঁজে পেয়েছি। আমাদের চলে যাওয়ার জন্য আরেফিনকে দায়ী করো না।’ আরেফিন দূর সম্পর্কের মামা। আয়াদের সঙ্গে নিখোঁজ হয় তার খালাতো ভাই আহমেদ রাফিদ আল হাসানও। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জঙ্গি হামলায় নিহতদের মধ্যে আয়াদ ও রাফিদের মৃত্যুর প্রাথমিক খবরে আঁতকে উঠেছিলেন মুনমুন। অবশেষে মুনমুন তার সেই সন্তানকে খুঁজে পেয়েছেন লাশ হিসেবে। গত শুক্রবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে আত্মঘাতী হয় আয়াদ। রোববার বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আয়াদের লাশ শনাক্ত করেন স্বজনরা। ধনাঢ্য বাবার তিন মেয়ের মধ্যে মুনমুন সবার বড়। বিয়ের পর স্বামী আলী হাসানের চাকরির সুবাধে দুই সন্তানকে নিয়ে সৌদি আরবে দীর্ঘ সময় থাকতে হয়েছে মুনমুনকে। আয়াদের লেখাপড়াও সৌদি আরবেই। সেখানে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে সে। স্বামীর মৃত্যুর পর মুনমুন তার বাবা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আইন উদ্দিনের বাসায়ই বসবাস করছেন।

পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট বিশ্বস্ত একটি সূত্র আয়াদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে নাম প্রকাশে কেউ রাজি হয়নি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একজন সহকারী কমিশনার রোববার দুপুরে জানান, শনিবার রাতে বিমানবন্দর থানা থেকে দুই সদস্যের পুলিশের একটি দল মুনমুন আহমেদের বাসায় যান। এ সময় তারা মুনমুনের কাছে জানতে চান, বিমানবন্দর এলাকায় নিহত ওই যুবক তার ছেলে আয়াদ কিনা। পুলিশের কথায় সাড়া দিয়ে পরে রোববার সকালে মুনমুন হাসপাতালে তার দুই স্বজনকে পাঠান। তারা সেখানে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। ওই দুই স্বজন পুলিশকে নিশ্চিত করেন যে, লাশটি আয়াদেরই। পরে মুনমুনও লাশটি তার ছেলের বলে শনাক্ত করেন। পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মুনমুন আহমেদ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করছেন।

রোববার বিকাল ৫টার দিকে পুলিশের এক কর্মকর্তাকে ফোন করেন মুনমুন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি আমার ছেলের লাশ চাই। তাকে নিজ হাতে দাফন করতে চাই। যারা আমার ছেলেকে মিসগাইড করেছে তাদের বিচার চাই।’ তিনি অভিযোগ করেন, যারা তার ছেলেকে মিসগাইড করেছে তারা প্রাকশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুনমুন আহমেদ বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় নিহত ছেলেটি আমার। কিন্তু এ নিয়ে আমি মিডিয়াকে কিছু বলতে চাচ্ছি না। যা বলার সবই পুলিশকে বলেছি। আপনারা থানায় যোগাযোগ করতে পারেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে যখন জানানো হল, সেখানে আমার ছেলে এবং ভাগ্নে আছে, তখন বিষয়টি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমাদের চট্টগ্রাম যেতে বললেও আমরা যাইনি। কারণ নিশ্চিত ছিলাম যে, সেখানে আমার ছেলে বা ভাগ্নের লাশ নেই।’

নিহতের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ঘটনায় লাশ শনাক্তে মুনমুন ও তার স্বজনদের ডিএনএ চেয়েছিল পুলিশ। এজন্যই তাদের চট্টগ্রাম যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা সেখানে না যাওয়ায় চট্টগ্রাম থেকে পুলিশ ঢাকায় এসে মুনমুন ও তার স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে। তবে ওই ডিএনএ রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিধান ত্রিপুরা  বলেন, ‘আমরা লাশের ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত নই। সেনসিটিভ ঘটনা হওয়ায় অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে। তবে আমরা পরিচয় নিশ্চিতের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। আশা করছি, দ্রুতই পরিচয় পাওয়া যাবে।’ বিমানবন্দর থানার ওসি নুরে আযম মিয়া  জানান, নিহতের সঙ্গে একটি মোবাইল ফোন পাওয়া গেছে। ওই মোবাইল ফোনটি তার পরিচয় নিশ্চিতে সহায়তা করছে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে এখনও চূড়ান্ত মন্তব্য করার সময় আসেনি বলে জানান তিনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এজাজ শফি জানান, ফরেনসিক সায়েন্সের মাধ্যমে নিহতের পরিচয় নিশ্চিতের চেষ্টা চলছে। এদিকে ১৭ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি কাউন্টার টোরোরিজম ইউনিটের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে গ্রেফতারকৃত জঙ্গি আরজিনা আক্তারের বরাত দিয়ে বলা হয়, সীতাকুণ্ডে নিহত চার জঙ্গি ও এক শিশুর সঙ্গে দুই খালাতো ভাই (আয়াদ ও রাফিদ) ছিল।

তখন কাউন্টার টোরোরিজম ইউনিট আরও জানায়, রাফিদ ও আয়াদের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার রিপোার্ট পাওয়ার পর এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে। এ বিষয়ে জানতে রোববার কাউন্টার টোরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুল মান্নান জানান, চট্টগ্রামে নিহত দুই যুবকের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জেলা পুলিশ ভালো বলতে পারবে। সীতাকুণ্ড থানার ওসি ইফতেখার হাসান জানান, ডিএনএ রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি। এ কারণে ওই দুই যুবকের পরিচয় নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগে মিডিয়াকে অনেক তথ্য দিতে পারতাম। এখন বাধ্যবাধকতার কারণে দিতে পারছি না।’
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn