জুয়েল রাজ- আগামী ৩ মে ব্রিটেনজুড়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সারা ব্রিটেন জুড়েই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ঠিক কতজন প্রার্থী নির্বাচন করছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা যায় সেটা কয়েকশত। বলা হয়ে থাকে ব্রিটেন জুড়ে ৫ লক্ষাধিক বাংলাদেশির বসবাস। তবে সেই সংখ্যা তারও অধিক বলেই ধারণা করা হয়। খুঁজলে সব কাউন্সিলেই কোন না কোন বাঙালি প্রার্থী পাওয়া যাবে। কিন্তু বাঙালিদের আগ্রহ টাওয়ার হ্যামলেটসকে কেন্দ্র করে।
 কারণ বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস থেকেই ব্রিটেনে বাঙালির অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা।  পার্লামেন্ট থেকে নির্বাহী মেয়র ভবন সব বিজয়রথ টাওয়ার হ্যামলেটস থেকেই ছুটেছে। পাশাপাশি সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোও  এখনো টাওয়ার হ্যামলেটস কেন্দ্রিক রয়ে গেছে। ব্রিটেনের রাজধানী যেমন লন্ডন, তেমনি ব্রিটেনের বাঙালিদের রাজধানী বলা যায় পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস। এবারের নির্বাচনে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ২০ টি ওয়ার্ডের ২৫৯ জন কাউন্সিল প্রার্থীর মধ্যে ১১৩ জনই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। ৭ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৪ জনের তিন জনই ব্রিটিশ বাংলাদেশি।
টাওয়ার হ্যামলেটেসের রাজনীতিতে বাঙালি সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর সেটা সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় নির্বাচনে ও প্রমাণিত। কারণ জন্মগত ভাবেই মনে হয় আমরা ভোটপ্রিয় জাতি বা রাজনীতি প্রিয় জাতি। বাঙালিদের মতো এতো উৎসব মুখর নির্বাচন খুব কম দেশেই হয় বলে আমার ধারণা। তেমনি টাওয়ার হ্যামলেটস ছাড়া ব্রিটেনের কোথাও নির্বাচনের কোন আমেজ পরিলক্ষিত হয়না। কাউন্সিলের ৩২ শতাংশ ভোটার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এবং ভোট প্রয়োগের হারও সবচেয়ে বেশী। ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ ভোট বিলাসী না। যতোটা না আমরা বাঙালিরা। এবং সেই ভোট প্রিয়তার কারণেই মূল ধারার রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে রেসপেক্ট পার্টির মতো আনকোরা একটি দল থেকে জর্জ গ্যালিও কে এম পি নির্বাচিত করতে পেরেছিল। লুৎফুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে লেবারকে চ্যালেঞ্জ করেই প্রথম নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকা খুব সহজ নয়। যার প্রমাণ লুৎফুর রহমানের অপমানজনক বিদায়।
ব্রিটেনের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা অভিবাসীদের লেবার পার্টি সংশ্লিষ্টতা বহু পুরাতন। যদিও এখন তৃতীয় চতুর্থের একটা অংশ কনজারভেটিভ পার্টির রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন। তবুও সিংহভাগই এখনো লেবার পার্টি সমর্থন করেন। বাঙালি ভোটের প্রভাব বুঝেই  টাওয়ার হ্যামলেটসে , এইবারই প্রথম, কোন বাঙালি কে মনোনয়ন দিয়েছে কনজারভেটিভ। ব্রিটিশ বাংলাদেশি যারা প্রার্থী হয়েছেন ড. আনোয়ারা আলী, রাবিনা খান কিংবা অহিদ আহমেদ এর যোগ্যতার এবং অভিজ্ঞতার বিচারে কেউ পিছিয়ে নেই। সম্ভাবনাময় এবং তরুণ নেতৃত্ব বলা যায়। অহিদ আহমেদ ডেপুটি মেয়র হিসাবে এবং রাবিনা খান ক্যাবিনেটের হাউজিং মেম্বার হিসাবে তাদের সফলতার প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু মেয়র হিসাবে আদৌ কি বাঙালি কোন প্রার্থী বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারবেন?
আদালতের রায়ে লুৎফুর রহমান সরাসরি রাজনীতির বাইরে থাকলেও, আন অফিসিয়ালি নতুন দল আসপায়ার এখনো লুৎফুর রহমানের দল হিসাবেই কমিউনিটিতে বিবেচিত। সেই জায়গা থেকে লুৎফুর রহমানের ভোট ব্যাংকের দাবীদার অহিদ আহামদ। যেহেতু নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে লুৎফুর রহমান দুইবার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। একই ভোটার ভোট দিয়েছিল। আবার সেই হিসাব কষলে গত নির্বাচনে রাবিনা খানের বিজয়ী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রায় ৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন রাবিনা। বিজয়ী হয়েছিলেন লেবার পার্টির প্রার্থী জন বিগস। আবার এই জন বিগসই দুইবার লুৎফুর রহমানের কাছে বিশাল ব্যবধানে ধরাশায়ী  হয়েছিলেন। অন্যদিকে বলা হয়ে থাকে কনজারভেটিভ দলের প্রায় ১০ হাজার দলীয় ভোট আছে এখানে। আগের বিভিন্ন নির্বাচনী ফলাফলেও এমনটাই দেখা গেছে। সেই হিসাবে, কনজারভেটিভ থেকে যেই প্রার্থী হউক না কেন,  তার বাক্সেই এই ভোট যাবে। এবং এই ভোটারদের সিংহভাগ আবার ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বা অন্যান্য জাতি সম্প্রদায়ের মানুষ। এখন এই ১০ হাজার ভোটের পরে বাকী ভোট যদি ডা. আনোয়ারা আলী নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে পারেন তবেই তিনি বিজয়ী হবেন। খুব সহজ হিসাবে দেখলে বাঙালি ভোট চার ভাগে বিভক্ত হবে। লেবার পার্টি সংশ্লিষ্ট ভোট জন বিগসের বাক্সেই যাবে। একটা অংশ বাকী তিন বাক্সে যাবে হয়তো।
আবার গত নির্বাচনে রাবিনা প্রায় ২৯ হাজার ভোট পেয়েছিলেন এইবার তা সোজাসুজি দুইভাগ হয়ে যাবে। এক ভাগ পাবেন অহিদ আহমেদ অন্যভাগ যাবে রাবিনা খানের বাক্সে। এই দুভাগেই আবার কনজারভেটিভের বাঙালি প্রার্থী হিসাবে ডা. আনোয়ারা ও একটা অংশ নিজের বাক্সে টেনে নিয়ে আসতে পারবেন বলেই দল থাকে মনোনয়ন দিয়েছে। বলা হয়ে থাকে টাওয়ার হ্যামলেটসে লুৎফুর রহমানের একটা বিশাল ভোট ব্যাংক আছে। এবং সেটা একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করেই বলা হয়।  লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের মধ্যে স্থানীয়দের একটি বিশাল অভিযোগ ছিল লন্ডনে তার জামায়াত ইসলামীর সাথে সখ্যতা এবং ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনকে নানাবিধ সুযোগ দেয়া। যার কারণে প্রগতিশীল একটি অংশ লুৎফুর রহমানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছিল। সাদা চোখে হিসাব কষলে রাবিনা খান এবং অহিদ আহমেদ গুরু মারা শিষ্য নিশ্চয় হতে পারবেন না। কারণ লুৎফুর রহমানের ছায়ার নীচে ঢাকা পড়ে আছেন দুইজনই। রাবিনা খান তার নতুন দল নিয়ে সেই ছায়ার বাইরে আসতে পারেন কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়। অহিদ আহমেদ এখনো সেই ছায়ার নীচেই আছেন। এই বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসা কারও পক্ষেই সম্ভব নয় বলে ধারণা সাধারণ ভোটারদের। লেবার পার্টির প্রার্থী জন বিগস, পোড় খাওয়া এক রাজনীতিবিদ। অভিজ্ঞতার ঝুলিও তার পরিপূর্ণ।  তাই সব হিসাব নিকাশ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত নিরাপদ জোনে আছেন লেবার পার্টির জন বিগস। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, জন বিগসের বিজয়ও নিশ্চিত বলার সুযোগ নেই। কারণ ব্রিটেনের নির্বাচনে  দ্বিতীয় পছন্দের একটা সুযোগ আছে। একজন ভোটার পছন্দের সেরা প্রার্থীকে ভোট দেয়ার পরও দ্বিতীয় পছন্দ হিসাবে অন্য আরেকজনকে ভোট দেয়ার সুযোগ আছে। সেই ক্ষেত্রে বাঙালি লেবার ভোটারগণ দ্বিতীয় পছন্দের ভোট কার বাক্সে দিবেন সেটিও ভোটের হিসাব পাল্টে দিতে পারে। যদি এককভাবে কোন প্রার্থী এই দ্বিতীয় পছন্দে ভোট পেয়ে যান তাহলে তার নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকে। ভোটার দ্বিতীয় পছন্দে তিনজনের যে কেউ একজন বিজয়ী হওয়ার সুযোগ আছে। একই গ্যাঁড়াকলে লেবার, পিপলস এল্যায়েন্স এবং আসপায়ার এর বাঙালি ১১৩ জন কাউন্সিলর প্রার্থী যারা আছেন। কারণ এক ভোট তিনজনকে ভাগ করে নিতে হবে।
মূল ধারার রাজনীতির বাইরে এসে শুধুমাত্র একটি কাউন্সিল ভিত্তিক কমিউনিটি ক্লাবের মতো রাজনৈতিক দল। কমিউনিটিতে যেমন বিভক্তির বীজ বোপন করা হয়েছে। তেমনি মূল ধারার রাজনীতি থেকে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা। তার উপর যোগ হয়েছে বাংলাদেশের মতো হানাহানি, একে অপরের উপর বিষেদাগার, রক্তারক্তির ঘটনাও ঘটেছে বাঙালি প্রার্থীদের মাঝে। সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি হলো, যারা কাউন্সিলর  মেয়র প্রার্থী হয়েছেন, তাদের মধ্যে তরুণ প্রজন্মের অনেকেরই উজ্জ্বল সম্ভাবনা এবং ক্ষমতা ছিল জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার। সেই পথটা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়ে গেলো কারণ মূল ধারার রাজনীতি বাদ দিয়ে “ভিলেজ পলিটিক্স” এর মতো শুধুমাত্র স্থানীয় কাউন্সিল ভিত্তিক রাজনৈতিক দল আগামীর কোন নেতা তৈরি করতে পারবে না। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, টাওয়ার হ্যামলেটের নির্বাচনে, বাঙালি ভোটারই জয় পরাজয়ের নিয়ামক। কিন্তু নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতোই অবস্থা এবারের নির্বাচন। এ যেন ভাত খায় আকবর মোটা হয় জব্বর। বাঙালিরা ভোট দিবে, জয় বিজয় নির্ধারণ করবে কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ না পাওয়ার আশংকাই প্রবল। জুয়েল রাজ, ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn