দিরাইয়ে নৌকাডুবি:বুধবার ছিল মোফাজ্জল মিয়ার বিয়ে। দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয়-স্বজনরাও এসেছিলেন বিয়ে বাড়িতে। অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের মতো মামার বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের আনতে গিয়েছিল বরের ভাই। কিন্তু বিধিবাম। পথে দিরাইয়ের কালিয়াকুটা হাওরে নৌকাডুবিতে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনায় আনন্দের পরিবর্ততে এই বাড়িতে চলছে কান্না রোল। এই বেদনাবিধুর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামের বর মোফাজ্জল মিয়ার বাড়িসহ তার আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে বিয়ের তারিখ। নিহতরা সবাই পরস্পর আত্মীয়-স্বজন। একই পরিবারের মা-সন্তানসহ একাধিক সদস্য রয়েছেন নিহতের তালিকায়। নৌকাডুবির পর মঙ্গলবার রাতে চার শিশুর ও বুধবার সকালে আরও ৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছয়জনই শিশু। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল ও স্থানীয় লোকজন লাশ উদ্ধার করেন।

নৌকাডুবিতে নিহতেরা হলেন, বর মোফাজ্জল মিয়ার মামাতো ভাই শিশু শহিদুল মিয়া (৪), একই গ্রামের নসিবুল্লার স্ত্রী করিমা বিবি (৭৮), পার্শ্ববর্তী নোয়ারচর গ্রামের আফজাল হোসেনের দুই ছেলে সোহান মিয়া (২), আসাদ মিয়া (৪) ও স্ত্রী আজিরুন নেছা (৩৫)। আজিরুন নেছা করিমা বিবির মেয়ে এবং দুই শিশু সোহান ও আসাদ তার নাতি। রফিনগর ইউনিয়নের মাছিমপুর গ্রামের জমসেদ আলীর মেয়ে শান্তা মনি (৩), আরজ আলীর স্ত্রী রহিতুন্নেছা (৩৫), তার মেয়ে তাছমিনা বেগম (১১), বাবুল মিয়ার ছেলে শামীম মিয়া (২), বদরুল মিয়ার ছেলে আবির মিয়া (৩)।

মঙ্গলবার রাতে উদ্ধার করা হয় শিশু আবির, শামীম, আজম ও সোহানের লাশ। অন্যদের লাশ উদ্ধার করা হয় বুধবার সকালে।  পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পেরুয়া গ্রামের ফিরোজ আলীর ছেলে মোফাজ্জল মিয়ার বিয়ের দিন তারিখ ধার্য ছিল বুধবার। বিয়ে উপলক্ষে মঙ্গলবার দুপুরে ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা দিয়ে বরের বাড়ির লোকজন মাছিমপুর গ্রামে গিয়েছিল আত্মীয়-স্বজনদের আনতে। বিকালে মাছিমপুর থেকে নৌকাটি পেরুয়া গ্রামে যাচ্ছিল। নৌকায় নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৩১জন যাত্রী ছিলেন। পথে কালিয়াকটা হাওরের আইনুল বিলে নৌকাটি ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা চালান। রাত দশটা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে চার শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। বুধবার সকালে ফায়ার সার্ভিস ও এলাকাবাসীর সহায়তায় হাওরের পানি থেকে একে একে আরও ছয়টি লাশ উদ্ধার করা হয়। নোয়ারচর গ্রামের নিহত আজিরুন নেছার চাচাতো ভাই পেরুয়া গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য হাবুল মিয়া বলেন,‘ বুধবার পেরুয়া গ্রামের ফিরোজ আলীর বাড়িতে আনন্দ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এখন এলাকাজুড়ে কান্নার রোল চলছে। আমার চাচী, চাচাতো বোন ও তিনটি ভাগ্নেকে হারিয়েছি হাওরে জলে। হাওরের সর্বনাশা ঢেউ আমাদের পরিবারের পাঁচজনকে কেড়ে নিয়েছে। আনন্দের পরিবর্তে কান্না দিয়েছে।’ তিনি জানান, বর মোফাজ্জলের মামার বাড়িতে তার এক চাচাতো বোনের বিয়ে হয়েছে। চাচী সেখানে গিয়েছিলেন বেড়াতে। বিয়ের নাইওরিদের সাথে আসতে গিয়ে এই দুর্ঘটনায় পড়েছেন তিনি।

স্ত্রী ও মেয়ে হারা মাছিমপুর গ্রামের আরজ আলী কান্না জড়িতকণ্ঠে বললেন, ‘আমার শ্যালিকার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিল আমার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী। পথে নৌকাডুবিতে আমার স্ত্রী ও মেয়ে মারা গেছে। আল্লাহ’র মেহেরবানীতে ছেলে কোনভাবে সাঁতরিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। হাওরের সর্বনাশা ঢেউ আনন্দ, হাসি-খুশির বদলে আমাদের শুধু কান্না দিয়েছে।’রফিনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজুয়ান খান বলেন, ‘এরকম ঘটনা আমাদের এলাকায় আগে কখনোই ঘটেনি। স্বজনহারা মানুষের কান্নায় হাওরের বাতাশ ভারী হয়ে উঠেছে।’ চরনারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রতন তালুকদার জানান, নৌকাতে ৩১ জন যাত্রী ছিলেন। নৌকা ডুবে যাওয়ার পর অন্যরা সাতরে তীরে উঠলেও ১০ জন নিখোঁজ হন। এই ১০জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক, আনন্দের পরিবর্তে বিষাদে ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা।’দিরাই থানার ওসি কেএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হাওর থেকে ১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশগুলো পরিবারের লোকজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) বিশ্বজিৎ দেব জানান, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদের নিদের্শক্রমে তাৎক্ষণিক নিহতদের পরিবারকে ৯০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn