হাসান শাহরিয়ার-

বহু প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যারা জীবনে কোনো একটি পেশাকে গ্রহণ করতে পারে না তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সুনামগঞ্জের তীক্ষèবুদ্ধিসম্পন্ন ও তুখোর ছাত্র ও যুবনেতা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী আব্দুল হাই। তিনি ছিলেন আঁধার ঘরের মানিক। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তার জীবনে অনেক সুযোগ আসে; কিন্তু একজন বোহেমিয়ানের মতো তিনি তা হেলায় হারিয়ে দেন। ফলে তার সুপ্ত  প্রতিভার বিকাশ ঘটেনি, যথাযথ মূল্যায়ণ হয়নি। বৃথা আশায় তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। একজন অভিমানি, উন্নাসিক ও উদাসীন ভাবাপন্নœ আব্দুল হাইয়ের জীবনের শুরু ও শেষ অবহেলিত প্রান্তিক শহর সুনামগঞ্জে। আমার বাবা সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক ও সমাজসেবক মকবুল হোসেন চৌধুরীর জীবনটাও ছিল অনেকটা এ রকম। তিনি ছিলেন আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ), সিলেটের ‘যুগবাণী’, ‘যুগভেরী’, ‘সিলেট পত্রিকা’  ও  কলকাতার দৈনিক ‘ছোলতান’ পত্রিকার সম্পাদক। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কাজের সন্ধানে তিনি তদানীন্তন সিলেট জেলার বাইরে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। দৈনিক ‘আজাদ’Ñএর মালিক মাওলানা আকরম খা তাকে ঢাকায় ‘আজাদ’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করার অনুরোধ জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জের আরেক কৃতী সন্তান দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের কথা মনে পড়ে। তিনি ছিলেন সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ও তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের উভয় পর্যায়েই  (১৯৪৮ ও ১৯৫২) তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে দাবি জানানোর কারণে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের কোনো কোনো স্থানীয় নেতা তার উপর নাখোশ ছিলেন। ফলে তার চাকরির উপর হুমকি আসে এবং ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী বড় ছেলে দেওয়ান নুরুজ্জামানকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে সিলেট কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। তবু তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করেন। অবশেষে ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন তিনি এবং ১৯৫৭ সালের শেষ দিকে অযোগ্যতা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ কাঁধে নিয়ে অনেকটা অনানুষ্ঠানিকভাবেই বিদায় নেন সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে। সম্ভবত এই অপমান ছিল তার জন্য শাপে বর। ঢাকায় আসার পর তার লুক্কায়িত প্রতিভা বিকশিত হয় এবং অচিরেই তিনি দেশের একজন শীর্ষ দার্শনিক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর তাকে জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয়। সুনামগঞ্জের সাপ্তাহিক ‘সাদেক’ সম্পাদক কবি প্রজেশকুমার রায় ঢাকায় গিয়ে ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেন। তবে ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি আততায়ীর ছুরিকাহাতে নিহত হন। সৈয়দ শাহাদাৎ হোসেন, মোস্তফা কামাল, সালেহ চৌধুরী, শামসুজ্জামান সুফি, হোসেন তওফিক চৌধুরী, মইনউদ্দিন চৌধুরী, বশির আহমদ, আবু সাঈদ জুবেরি, সাকির আহমদ, পীর হাবিবুর রহমান প্রমুখ ঢাকায় গিয়ে দক্ষতার সঙ্গে সাংবাদিকতা পেশায় অবদান রাখেন। বলা বাহুল্য, প্রতিভাধর আব্দুল হাই যদি ঢাকায় পাড়ি জমাতেন তাহলে তিনিও অবশ্যই পরিশ্রম ও মেধার বলে সসম্মানে পেশার শীর্ষে  অবস্থান করতেন।

আব্দুল হাইয়ের জীবন  ছিল বর্ণাঢ্য। জন্ম সুনামগঞ্জ শহরের আরফিন নগরে, ১৯২৯ সালে। সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯৪৮) এবং সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে ১৯৫১ সালে আই.এ পাস করে তিনি সিলেট মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজে ভর্তি হন। তবে রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারপর তিনি সিলেটের মদনমোহন কলেজে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হন। মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারির সৈনিক। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সরকারের শ্যানদৃষ্টি তার ওপর পড়ে। ফলে অচিরেই তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ১৯৫৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার থেকে তিনি বি.এ পাস করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু সারা দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করায় তিনি সুনামগঞ্জে চলে আসেন। মনে আছে, গৌরিপুরের কাচারির আঙ্গিনায় লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। প্রসুনকান্তি রায় (বরুণ রায়) প্রেফতার হলে আব্দুল হাই সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ছোট হলেও আমার ভাই হোসেন তওফিক চৌধুরী ও আমি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এই কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম এবং তা সম্ভব হয়েছিল আব্দুল হাইয়ের জন্য। উচ্চতর শিক্ষা বা ভাগ্যের অন্বেষণে আর তিনি ঢাকামুখি হননি।        

আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ট পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তার মা মোর্শেদা বেগম চৌধুরী সম্পর্কে আমাদের বোন ছিলেন। যখন মন চাইতো তখন তিনি আমাদের হাসননগরের বাসায় চলে আসতেন। আমার বাবা ও মা তাকে খুব ¯েœহ করতেন। আব্দুল হাই এবং তার বড়ভাই তারা মিয়া সব সময় আমাদের মামা বলে সম্বোধন করতেন। যেহেতু তারা আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলেন তাই আমরাও তাদের মামা বলে ডাকতাম। 

সর্বক্ষেত্রেই ছিল তার পদচারণা। অনেকটা জুতা সেলাই থেকে চ-িপাঠ। তার সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘দেশের দাবী’ (১৯৫৬Ñ৫৮) ছিল একটি উচ্চাঙ্গের পত্রিকা। এর প্রকাশক ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেইন বখত। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সারিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন একজন সংগঠক, মঞ্চ নাটক পরিচালক ও অভিনেতা। তার হাতেই গড়ে ওঠে  সুনামগঞ্জ আর্টস কাউন্সিল (পরে শিল্পকলা একাডেমি)। তিনি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি।

তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিশেষ অবদান রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে স্বাধীনতার স্বপক্ষে তিনি ‘জনমত’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর তিনি ‘দেশের কথা’ এবং ‘সূর্যের দেশ’ নামে দু’টি পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান দেশের প্রতিটি জেলা ও মহকুমা থেকে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সরকারি অর্থে পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল তার গুণগান করা। এই লক্ষ্যে মহকুমা অফিসার আব্দুল আউয়ালের পৃষ্ঠপোষকথায় ১৯৬২ সালে সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘সুরমা’। এই পত্রিকার সম্পানার দায়িত্বভার পড়ে আব্দুল হাইয়ের ওপর। তবে সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ এ এইচ এম এ কুদ্দুস ছিলেন নামসর্বস্ব প্রধান সম্পাদক। যেহেতু আব্দুল হাই তখনও জয়কলস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে ইস্তফা দেননি, তাই কলেজের বাংলার অধ্যাপক রামেন্দুভূষণ রায়কে নিযুক্ত করা হয় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। আমি তখন ঢাকার দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা। আব্দুল হাই আমাকে ‘সুরমা’য় কাজ করতে বলেন। সংবাদ সংগ্রহ ছাড়াও ছোটদের বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হলো আমাকে। বলতে গলে ‘সুরমা’ পত্রিকায়ই আমার হাতেখড়ি। ভাগ্নে আব্দুল হাই ছিলেন গুরু। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। আমাদের এই সম্পর্কে কোনোদিন ফাটল ধরেনি। ১৯৮৩ সালের ২৫ এপ্রিল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পূর্বে তিনি আমার ঢাকার বাসভবনে কয়েকদিন অবস্থান করেন। এ ছিল আমার অতিরিক্ত পাওনা। গুরু দক্ষিণা দেইনি, কিন্তু গুরুসেবা করে তার মন জয় করার চেষ্টা করেছি।

আমি এই নিবেদিতপ্রাণ মহর্ষির রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।

*হাসান শাহরিয়ার: সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (সিজেএ)Ñএর ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস এবং বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো। 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn