মাহমুদ ফেরদৌস –

যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা হেনরি কনজ্যাক। বর্তমানে তার বয়স ৬৫। পেশায় গীতিকার ও ভিডিও প্রযোজক। ২০০৮ সালের দিকে হঠাৎ তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জানা গেল তার রক্তে দূষণ দেখা দিয়েছে। এরপর টানা এক মাস এন্টিবায়োটিক নিতে থাকেন তিনি।কিন্তু দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়েনি। কিছুদিন পর জানা গেল যে, তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার মিট্রাল ভাল্ব প্রতিস্থাপন করতে হবে। হাসপাতাল থেকে জানানো হলো, সব মিলিয়ে খরচ পড়বে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। তা-ও আবার সার্জনের ফি বাদ দিয়ে। কনজ্যাকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। বয়স ৫০ পেরিয়ে যাওয়ার পর আচমকা তার স্বাস্থ্য বীমা বাতিল হয়ে যায়। আরেকটি বীমা করার সামর্থ্যও তার ছিল না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খরচ কমাতে রাজি নয়। কনজ্যাকের হাতে তখন দু’টি রাস্তা খোলা। এক. দেউলিয়া হয়ে যাওয়া। দুই. মৃত্যু। কনজ্যাক এই দুই বিকল্প বাদ দিয়ে, তৃতীয় একটি বিকল্প বেছে নিলেন। সেটি হলো, ভারত। ওই বছরের ২৩শে ডিসেম্বর নয়াদিল্লির ইন্দ্রপ্রশান্ত এ্যাপোলো হাসপাতালে সফলভাবে তার অস্ত্রোপাচার সম্পন্ন হয়। ভারতে তিন সপ্তাহের সফরে, বিমান ভাড়া থেকে শুরু করে হাসপাতালের খরচ সহ তার মোট ব্যয় দাঁড়ায় মাত্র ১০ হাজার ডলার। কনজ্যাকের ভাষায়, ভারতে চিকিৎসা করিয়ে তিনি নিজের জীবন ও ব্যবসা দু’টোই বাঁচিয়েছেন।  কনজ্যাকের গল্প বিরল হলেও, ভারত গিয়ে চিকিৎসা করানো বিদেশিদের দলে তিনি একা নন। চিকিৎসার খরচ জোগাতে সংগ্রাম করছেন এমন বহু আমেরিকানের কাছে ‘মেডিক্যাল ট্যুরিজম’ খুবই আকর্ষণীয় একটি সিদ্ধান্ত। এক সরকারি জরিপ অনুযায়ী, প্রতিবছর ৩ লাখেরও বেশি আমেরিকান নাগরিক চিকিৎসার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেন। তাদের বেশির ভাগই অর্থ বাঁচাতে এই পথ বেছে নেন।
এমন আমেরিকান রোগীদের কাছে ভারত লোভনীয় দেশগুলোর একটি। কারণ, দেশটিতে বেশকিছু হাসপাতাল আছে, যেখানে সাশ্রয়ীমূল্যে উন্নত মানের চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়। পাশাপাশি ইংরেজিতে কথা বলতে পারে এমন পেশাদার কর্মীও রয়েছে অনেক। বিদেশী রোগী পেয়ে ভারতের চিকিৎসা শিল্পও বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। ফোর্টিস হেলথকেয়ারের আন্তর্জাতিক বাজারজাতকরণ পরিচালক বিনায়ক শৌরি জানান, তার কোম্পানির মোট আয়ের ২০ শতাংশ আসে বিদেশী রোগীদের কাছ থেকে। আর এই হার বেড়েই চলেছে।  চিকিৎসা শিল্পের উন্নতি ঘটাতে ভারত ২০০৫ সালের জুন মাস থেকে মেডিক্যাল ভিসা চালু করে। সম্প্রতি প্রায় ১৫০টি দেশের নাগরিকদের জন্য অনলাইনে ভিসার আবেদন করার প্রক্রিয়াও চালু করেছে দেশটি। ২০১৬ সালে পর্যটন মন্ত্রণালয় ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মেডিক্যাল ভিসার অনুমোদন দিয়েছে। ২০১৫ সালের চেয়ে যা ৪৫ শতাংশ বেশি। ভারতে এটা এখন বেশ বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। চিকিৎসা শিল্পের এমন অবস্থা থাকলেও, ভারতে স্বাস্থ্যসেবা বৈষম্য বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ধনী ও গরিবের মধ্যে এই বিভাজন ক্রমাগত হারে বেড়েই চলেছে। গ্রামীণ অঞ্চলের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষের কোনো স্বাস্থ্যবীমা নেই। ভারতের চেন্নাই শহরের অর্থোপেডিক সার্জন জর্জ থমাস বলেন, ভারতে আপনার কাছে অর্থ থাকলে, আপনি সবরকমের চিকিৎসাসেবা পাবেন। অন্যদিকে, দেশের বহু মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবাও পায় না। মেডিক্যাল ট্যুরিজম তাই ভারতের চিকিৎসা শিল্পে সুযোগ ও ঝুঁকি দু’টোই নিয়ে এসেছে। ভালো দিকটা হলো, বিদেশি রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে দেশের মেডিক্যাল ব্যবসা আরও উন্নত হচ্ছে। অর্থাৎ, স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা যাবে। আর খারাপ দিক হলো, সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতাল এক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালই গরিব মানুষের সম্বল। কিন্তু মান উন্নত হচ্ছে ব্যবসায়ী হাসপাতালগুলোর। বেসরকারি হাসপাতাল যন্ত্রপাতি থেকে কর্মী সব ক্ষেত্রেই সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বহুগুণ উন্নত। বিদেশি রোগীরা তাই সেসব উন্নত হাসপাতালগুলোই বেছে নেন।
একজন আমেরিকান নাগরিকের জন্য ভারতের উঁচুমানের অভিজাত হাসপাতালের খরচ তুলনামূলকভাবে বেশ কম। কিন্তু একজন সাধারণ ভারতীয়র জন্য তা অনেক বেশি। পাশাপাশি বেশির ভাগ আমেরিকান নাগরিকের মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্স করা থাকলেও ভারতীয়দের ক্ষেত্রে তা একেবারেই উল্টো।  বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চেয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা খরচ নিশ্চিতভাবেই অনেক কম। দেশটির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার হাসপাতাল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। দেশের দরিদ্র নাগরিকরা যেন সরকারি হাসপাতালে কম খরচে বা বিনা খরচে চিকিৎসা সেবা পায়, সেজন্যে বেশ কয়েকটি প্রোগ্রাম চালু আছে ভারতে। এ কারণেই সরকারি হাসপাতালে সার্বক্ষণিক মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকে। সামর্থ্যের বেশি রোগী সামলাতে হয় সরকারি হাসপাতালগুলোকে। ফলে কয়েকদিন পরপরই রোগীদের ভুল চিকিৎসার শিকার হওয়ার খবর পাওয়া যায়। যেমন, সম্প্রতি ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের এক হাসপাতালে অক্সিজেন ঘাটতির কারণে ৬৩ জন শিশু মারা গেছে। এসব নেতিবাচক কারণে স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয়রা চিকিৎসার জন্য সরকারির বদলে বেসরকারি হাসপাতালই বেছে নেন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এক সরকারি প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো ৩০ শতাংশেরও কম মানুষের অসুস্থতা সারিয়েছে। বিশেষ করে, বড় বড় শহরে এই হার আরও কম। কারণ, দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল বড় শহরেই অবস্থিত। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে শহরে সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালে খরচ বেশি হওয়া সত্ত্বেও এসব হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর পরিমাণ প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে প্রত্যেক শহুরে হাসপাতালে রোগীদের আগমন প্রায় ১৭৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১৪ সালে ভারতের মোট সরকারি জিডিপি’র মাত্র ১.৪ শতাংশ ব্যয় করা হয় স্বাস্থ্যসেবায়। পুরো বিশ্বের মধ্যে যা নিচের দিক থেকে ১৫তম। এই খাতে সরকারি অর্থায়নের প্রভাব অনুমেয়।  বহু সরকারি হাসপাতালে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। এই ঘাটতি চিকিৎসকদেরও নাড়া দেয়। দেশে প্রতি ১০১৮৯ জন নাগরিকের জন্য মাত্র একজন করে সরকারী চিকিৎসক নিয়োজিত আছেন। এসব চিকিৎসকদের বেতন বেসরকারি খাতের চিকিৎসকদের চেয়ে অনেক কম। ফলে বহু চিকিৎসক লোভনীয় বেসরকারি হাসপাতালে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আন্তর্জাতিক রোগীদের চিকিৎসা করা হয় এমন (বেসরকারি) হাসপাতালকে সরকারের দেয়া সুযোগ সুবিধাও এক্ষেত্রে উদ্বেগজনক। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ ধরনের হাসপাতালকে ‘মার্কেটিং ডেভেলপমেন্ট এসিস্ট্যান্স স্কিম’-এর আওতায় আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। নয়াদিল্লির ৪৩টি হাসপাতাল শহরে হাসপাতাল তৈরির জন্য স্বল্পমূল্যে জমি পেয়েছে। সরকার এসব ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি হাসপাতালকে শর্ত দিয়েছিল যে, নিম্নবিত্তদের জন্য অন্দর-বিভাগে ১০ শতাংশ ও বহির্বিভাগের ২৫ শতাংশ সেবা সংরক্ষিত রাখতে হবে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব নিয়ম মেনে চলা হয় না।  ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার এই বৈষম্য কনয্যাককেও নাড়া দিয়েছিল। ভারত সফরে গিয়ে সেখানকার দরিদ্র্য চোখে না পড়াটাই অসম্ভব। কিন্তু কনয্যাক সেখানে দুনিয়াকে বাঁচাতে যায়নি, গিয়েছিল নিজের প্রাণ বাঁচাতে। তার ভাষ্য, এটা (ভারতের দারিদ্র্য) আমাকে পীড়া দিয়েছিল। কিন্তু তার যুক্তি, ‘আমিও তো মারা যাচ্ছিলাম।’ (ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন অবলম্বনে)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn