তাহেরা হাসান:১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণে বেশ কিছু ভয়াবহ পরিণাম দেখতে পেয়েছে এ অঞ্চল। ২০২৩ সালে এসেও তার অনেক প্রভাব টের পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৭০ এর দশকের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অভিবাসন অব্যাহত ছিল। নির্দিষ্ট আইনের ভিত্তিতে পাকিস্তানে যাওয়া এই মানুষদের নাগরিকত্বের আবেদন করতে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর অধীনে পাকিস্তানে যাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত বাঙালি এবং বাংলা ভাষাভাষীদের একটি পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছিল।

তাছাড়া পাকিস্তান নাগরিকত্ব আইনে জন্মগত নাগরিকত্বেরও বিধান রয়েছে। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী প্রতিটি শিশুই পাকিস্তানি। যাইহোক, পাকিস্তানের সিস্টেমকে বৈষম্য এবং জেনোফোবিয়া (বিদেশী আতংক) ভয়াবহভাবে গ্রাস করেছে। এই বৈষম্য এবং বাঙালিদের আলাদা চোখে দেখার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এর কারণে বাঙালিদের নিয়ে পাকিস্তানে একটি আলাদা বাস্তবতা তৈরি হয়েছে এবং তাদেরকে এখন ভিন্ন জাতির মানুষ হিসাবে দেখা হচ্ছে। তাদের একটি বড় অংশই এখনও রাষ্ট্রহীন হয়ে আছে। তাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। কাগজপত্র করতে গেলেও তাদেরকে নানা ঝামেলার মুখে পড়তে হচ্ছে।

এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে কাজ করতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করেছি যে, অসংখ্য ধরণের বাধা তাদের সামনে ফেলা হচ্ছে যার কারণে তারা নিজেদের জন্য কোনো পরিচয়পত্র তৈরি করতে পাড়ছে না। যাদের এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সমস্যা দেখা গিয়েছে, তারা তার সমাধান পর্যন্ত করতে পাড়ছে না। আর এর জন্য সবথেকে বেশি সমস্যা করছে তাদের জাতিগত পরিচয় এবং আর্থসামাজিক অবস্থান। পাকিস্তানে থাকা বাঙালিদের খুব অল্প মানুষই পড়াশুনার সুযোগ পাচ্ছে। এই মানুষেরা তাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞাত। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদেরকে এই অবহেলার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

২০০০ সালের পরপর বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছিল যাতে বাঙালিদের নিবন্ধনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া বেশ কিছু পরিবারের নাগরিকত্ব পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়। এসব পরিবারের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, চাকরি, আবাসন এবং উন্নতি বাধাগ্রস্থ হয়। এই সংকটের প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের জাতিগত পরিচয়। তাদেরকে এখনও বিদেশী বলে গণ্য করা হয়।

সম্প্রতি পাকিস্তান সরকার অনলাইনে নাগরিকদের আদমশুমারির ব্যবস্থা চালু করেছে। এতে একজন পাকিস্তানি চাইলে নিজেই অনলাইনের মাধ্যমে নিজের পরিচয় দাখিল করতে পারবে। এতে করে আদমশুমারি থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায়ও বড় বৈষম্য দেখা গেছে। ওই অনলাইন ফর্মে বাংলাকে কোনো ভাষা হিসেবে যুক্ত করা হয়নি। অথচ পাকিস্তানে বিপুল পরিমাণ বাংলাভাষী রয়েছেন। সেখানে বাঙালিকে একটি জাতীয়তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারলাম না যে বাঙালি কোনো জাতীয়তা নয়, এটি একটি ভাষা। বাংলাদেশি হচ্ছে জাতীয়তা। তাই ভাষার জায়গায় বাংলা যুক্ত করে, জাতীয়তার কলামে বাংলাদেশি যুক্ত করা যেতে পারে। বিশ্বের সকল বাংলাভাষী বাংলাদেশের নাগরিক নন। এ ধরণের ভুল উপস্থাপন এবং অসঙ্গতির সংখ্যা ব্যাপক।

এই ভুলের কারণে একজন বাংলাভাষী পাকিস্তানি নাগরিককে নানা হেনস্থা ও বৈষম্যের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যদিও তার কাছে সকল বৈধ নথি, সিএনআইসি এবং পাসপোর্ট আছে। কিন্তু তারপরও তাকে জাতীয়তার স্থানে লিখতে হয় বাঙালি। ফলে এরপর থেকে তিনি পাকিস্তানি হওয়া সত্বেও বাঙালি হিসেবে পরিচিত হন এবং বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। পাকিস্তানে বাঙালিদের তিনটি প্রজন্ম পাড় হয়েছে, অথচ এখনও তাদেরকে পাকিস্তানি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। তাদের বড় একটি অংশই এখন রাষ্ট্রহীন এবং পরিচয়পত্রহীন হয়ে আছে।

রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কখনও আমাদের নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন করিনি। আমরা আমাদের জন্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের আইনেরও প্রয়োগ করিনা। নতুন প্রজন্মের পাকিস্তানিদের আমরা তাদের নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি। আমরা সংবিধানের আর্টিকেল ২৫-এ কে ভুলে গেছি। শিশুদের জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার শিক্ষাকে তাদের থেকে কেঁড়ে নিয়েছি।

আবারও পুনরাবৃত্তি করা প্রয়োজন যে, বৈষম্যের অন্তর্নিহিত কারণ হল জাতিগততা এবং অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস। আদমশুমারির তথ্যের ভুল গ্রহণকে সংশোধন করা দরকার। এরইমধ্যে বৈষম্যের শিকার সম্প্রদায়কে যেনো আরও বাধার সামনে না ফেলি আমরা। তথ্য সংগ্রহ এবং সংযোগজন প্রক্রিয়া অবশ্যই সঠিক এবং ন্যায্য হতে হবে। (করাচিভিত্তিক গণমাধ্যম ডনে প্রকাশিত লেখক ও আইনজীবী তাহেরা হাসানের লেখা থেকে অনূদিত)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn