সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগে নতুন মেরুকরণঃ স্থায়িত্ব কতদিন?-তিন
সুজাত মনসুর-

সুনামগঞ্জ-৫ নির্বাচনী এলাকাটি ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা নিয়ে গঠিত। এক সময় এটা ছিল ছাতক ও দক্ষিন জগন্নাথপুর নিয়ে গঠিত। আমি যখন ৮০ সালে ছাতক কলেজে ভর্তি হই, তখন আমার থাকার জায়গা হয়েছিল বর্তমান পৌর মেয়র আবুল কালাম চৌধুরীদের বাড়িতে। কালাম অষ্টম শ্রেনীতে এবং শামীম পড়তো চতুর্থ শ্রেনীতে। বর্তমান সাংসদ মহিবুর রহমান মানিক তখন ছাত্র একতা কেন্দ্রের সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তখন ন্যাপ ছেড়ে এসে একতা পার্টি করেছিলেন।. আমি তখন দিরাই থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সহ সম্পাদক। সভাপতি ছিলেন মতিউর রহমান পীর ও সাধারণ সম্পাদক হায়দর চৌধুরী লিটন।

ছাতকে গিয়ে দেখি আওয়ামী লীগের বিরাট সংগঠন আছে, কিন্তু ছাত্রলীগের অবস্থা তেমন ভালো না। কেননা, যারা নেতৃত্বে আছেন তারা মেয়াদ উত্তীর্ন ও সক্রিয় নন। তবে ছাত্র ইউনিয়নের অবস্থা ভালো ছিল। সেই সময় যে কজন ছাত্রলীগের কর্মী সক্রিয় ছিলো তারমধ্যে আবুল কালাম চৌধুরী অন্যতম। তার বড় ভাই শাহজাহান চৌধুরী এমসি ইন্টারমেডিয়েট কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। মুহিবুর রহমান মানিককে ছোটবেলা থেকে চিনতাম। আমার আব্বা ও উনার আব্বা একই সাথে দিরাইতে চাকুরী করতেন। পারিবারিকভাবে ভালো সম্পর্ক ছিল। উনার বাবাকে নানা বলে সম্মোধন করতাম।

যাইহোক, ছাতক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা খুবই ভালো ছিল। বিশেষ করে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম ও যুবনেতা চানমিয়া সবাইকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন কর্মসুচি পালন করতেন। তখনকার সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যাদের নাম এখন মনে পড়ে তারা হলেন আবরু মিয়া তালুকদার, লুৎফুর রহমান ছরকুম, গোপাল বাবু, ধারনের আরজক আলী(যুবলীগ করতেন), এডভোকেট আকিকুর রহমান(পরে সম্ভবতঃ জাতীয় পার্টিতে যোগদেন), হিরন মিয়া। আমরা সালাম ভাই আর চান মিয়া ভাইর সহযোগিতায় কয়েকমাসের মধ্যে ছাতকের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ থানা সদরে ছাত্রলীগকে একটি বিশাল সংগঠনে পরিণত করি। জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম যেদিন সিলেট শাহজালাল(রঃ)-এর মাজার জিয়ারত করতে আসেন সেদিন ছাতক থেকে আমরা এক বিরাট মিছিল নিয়ে যোগদান করেছিলাম।

বলছিলাম ছাতক আওয়ামী লীগের কথা। সাংগঠনিক কাঠামো বিশাল হলেও কোন প্রকার দ্বন্ধ-সংঘাত ছিল না, বিভক্তি ছিল না। ছাতক আওয়ামী লীগে মূলতঃ দ্বদ্ধ সংঘাতের সুত্রপাত হয় ১৯৯১ সালে মহিবুর রহমান মানিক জোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা নিয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করার সময় থেকে। এরপর তিনি যখন ১৯৯৪ সালে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাথে সরাসরি আওয়ামী লীগের যোগদান করেন তখন থেকে তা প্রকট আকার ধারণ করে। একজন বহিরাগত হিসেবে ও স্থানীয় রাজনীতিতে পুর্ব শত্রুতার জের ধরে পর্যায়ক্রমে তা কালাম গ্রুপ ও মানিক গ্রুপের দ্বন্ধে পরিণত হয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে পৌরসভা ও জাতীয় নির্বাচনে উভয় গ্রুপই নিজের অবস্থান বজায় রাখায় অটল রয়েছে। প্রতিটি পৌর নির্বাচনে মানিক কালামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পরাজিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আর কালামরা তার বিরোধিতা করেছে। তবে শোনা যায়, ২০০৮-এর নির্বাচনে সে পর্যন্ত নাকি কালাম চৌধুরীরা মানিক সাহেবের পক্ষে কাজ করেছিল, এই শর্তে যে, তিনি উপজেলা নির্বাচনে শামীম চৌধুরীকে সমর্থন করবেন। তবে তিনি নাকি শেষ পর্যন্ত কথা রাখেননি, বরং উনার পক্ষের প্রার্থী আবরু মিয়াকে সমর্থন করলেও, মূলতঃ বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান চৌধুরী যাতে পাশ করে সে চেষ্টা করেন। ফলে পরবর্তীতে আবরু মিয়া তালুকদার মানিক বলয় পরিত্যাগ করে কালামদের সাথে যোগদেন এবং এখনো আছেন বলেই মনে হয়। এসবই আমার শোনা কথা। এবং গত উপজেলা নির্বাচনে মানিক তার আপন ভগ্নিপতিকে জিতিয়ে আনতে ভুমিকা রাখেন।

কালামরা পুরনো আওয়ামী লীগার এবং মানিক আওয়ামী লীগে নতুন এবং স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের পুর্ব শত্রুতার জের, তাই স্বাভাবিক কারনেই মুহিবুর রহমান মানিক আওয়ামী লীগে যোগদান করার সাথে সাথেই দ্বন্ধ-সংঘাত শুরু হয়ে যায়, শুরু হয় বিভক্তির রাজনীতি। সৃষ্টি হয় কালাম ও মানিক গ্রুপ, জাতীয় রাজনীতির দুই দিকপাল সামাদ আজাদ ও সেনগুপ্তের আশির্বাদ নিয়ে। এক পর্যায়ে মানিকের বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে বাবুলসহ কয়েক নিহত আহত হয়। সেই মামলায় মানিকের সাজা হয় এবং পরে হাইকোর্ট থেকে মুক্তিলাভ করেন। সামাদ আজাদ গ্রুপের অভিযোগ, মানিক নাকি সামাদ আজাদকে হত্যা করার জন্য বোমা বানানোর হুকুম দিয়েছিলেন।

যে কথা বলছিলাম। মানিক যেহেতু আওয়ামী লীগে বহিরাগত এবং কালামদের সাথে পুর্ব শত্রুতার জের রয়েছে, সুতরাং মানিকের দায়িত্ব ছিলো তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করা। তিনি যদি কালামকে পৌরসভায় কিংবা শামীমকে উপজেলা পরিষদে মেনে নিতেন, সহযোগিতা করতেন তাহলে শীতল সম্পর্ক অনেকটাই কমে আসতো বলে আমার বিশ্বাস। আমরাও তখন বলতে পারতাম, মানিক তো চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি তা না করে গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে কালামদেরকে আওয়ামী লীগ থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করেছেন। সব জায়গায় নিজের লোকজনকে বসানোর চেষ্টা এখনো অব্যাহত রেখেছেন। আর এই দ্বন্ধ-সংঘাতে বরাবরই রসদ যুগিয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃ্ন্দ। বিশেষ করে মতিউর রহমান, নুরুল হুদা মুকুট, আইয়ুব বখত জগলু, ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন ও আমাদের সাংসদরা। এই দ্বন্ধ-সংঘাতের দাবানলে আজ তৃণমুলের নেতাকর্মীরা জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৫ আসনটি জেতা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

সুতরাং তৃণমুলে সংঘাত রেখে জেলার কতিপয় নেতার তথাকথিত ঐক্য কি নৌকার বিজয় নিশ্চিত করা যাবে? অথবা মতিউর-মুকুট-ইমনের নতুন করে গড়ে উঠা ইমানী ঐক্য কি ছাতক-দোয়ার বিভাজন দুর করতে পারবে? প্রবাদ আছে, যা হয়নি নয়-এ, তা কি করে হবে নব্বই-এ? আজ ইমন যে কালাম চৌধুরীকে সাথে নিয়ে মুকুটের সংবর্ধনায় যোগ দিচ্ছেন, তা কি মানিক হাসিমুখে মেনে নেবেন? সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের নতুন মেরুকরনের ফলে, মানিক কি জেলার রাজনীতিতেনিজের অস্তিত্ব রক্ষায় নতুন মিত্র খুঁজে নেবেন না? কিংবা মানিকের সতীর্থ অন্যান্য সাংসদরা কি মানিককে বাদ দিয়ে তাদের ইমানী ঐক্যে সামিল হবেন? নাকি মানিকসহ অন্যান্য সাংসদরা ইমনকে বাদ দিয়ে জগলুর সাথে আরেকটি ইমানী ঐক্য গড়ে তুলবেন? বাস্তবতা কিন্তু তারই ইঙ্গিত বহন করছে।

মানিক ও শামীম দুজনই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী। এখন নতুন মেরুকরনের নেতারা কার পক্ষে অবস্থান নেবেন মানিক না শামীম? মানিক কিংবা শামীমই বা তাদের কথা শুনবেন কেন? তাদের সে গ্রহণযোগ্যতা কি আছে?
(চলবে। আগামীকাল পড়ুন সুনামগঞ্জ-২ নিয়ে চতুর্থ পর্ব)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn