মরিয়ম চম্পা-

অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান। সম্প্রতি সুলতানা শাহানা বানু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, আমি যেহেতু সরাসরি ল্যাবে কাজ করি তাই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ রয়েছে। জেনেশুনে বিষ করেছি পান। সুতরাং বিশ্ব স্বাস্থ্যের নির্দেশনা অনুযায়ী যারা করোনা নিয়ে কাজ করেন তাদের প্রতি সপ্তাহে করোনা পরীক্ষা করতে হবে। সেই হিসাবে প্রতি সপ্তাহে করোনা পরীক্ষা না করলেও জুলাইয়ে মনে হলো আমাদের প্রত্যেকেরই প্রতি সপ্তাহে করোনা পরীক্ষা করা উচিত। এ সময় দেখলাম সকলেই মোটামুটি পজেটিভ হচ্ছে। তখন মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম আমারও পজেটিভ হবে।

প্রথমবার নেগেটিভ আসলো। এর ১৫ দিন পরে পরীক্ষা করে পজেটিভ হলাম। স্ট্রংলি পজেটিভ। যেহেতু আমার হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিকসহ অন্যান্য সমস্যা রয়েছে। মানসিকভাবে যতই পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে থাকি না কেন হঠাৎ মনে হলো হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেল। এ সময় আমার সহকর্মী সহযোগী অধ্যাপক যারা ছিলেন তারা খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন আমার জন্য। ২৯শে জুলাই সকালে স্যাম্পল দিলে সন্ধ্যা ৭টায় জানতে পারলাম আমি করোনা পজেটিভ। তাদেরকে বললাম- তোমরা আবার পরীক্ষা করো। আমি একটু বসি। অবশেষে পর্যালোচনা করে দেখলাম স্ট্রংলি পজেটিভ। তখন মনে হয়েছে হয়তো আমি আর সার্ভাইব করবো না। খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম কেন জানি না। সহকর্মীরা বললেন- আপা বাসায় চলে যান। গাড়িতে চুপচাপ বাসায় আসলাম। আসার পরে সহযোগী অধ্যাপক যখন ফোন দিলেন তখন কথা বলতে পারছিলাম না। কান্না করছিলাম। তিনিও আমার সঙ্গে কাঁদছেন। খুব মন খারাপ নিয়েই বাসায় গিয়ে গোসল করে খাওয়া-দাওয়া করলাম।

তিনি বলেন, আত্মীয়স্বজন এবং ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী কাউকে কিছু জানালাম না। ভীতি কাজ করছিলো। কারণ, তখন দেখা যাবে আমাকে সবাই একঘরে করছে। আমার এক প্রতিবেশী লক্ষ্য করেছে অনেকদিন ধরে অফিসে যাচ্ছি না। বাসার দারোয়ানদের মাধ্যমে তখন সে জানতে পারলো আমি করোনা আক্রান্ত। একদিন আমি খাবার নিতে দরজা খুলেছি তখন দেখলাম সে কোথাও যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। এটা আমার জন্য বড় কোনো বিষয় না হলেও অনেকের জন্য খুব বড় কিছু। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ। অথচ ভবনের সকলের যেকোনো অসুস্থতা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আমার কাছেই আগে আসতেন। তারা সকলেই আমার পেসেন্ট। সে যখন মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয় তখন আমি তাকে দেখে ফেলেছি। সে কিন্তু আমাকে একবারও জানতে চায়নি। তখন একটু খারাপ লেগেছিলো। কিন্তু পরক্ষণে এটা আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক লেগেছে যে, একটি মানুষ ভয় পেতেই পারে। এ সময় সকলের সঙ্গে মেলামেশা এবং যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। পরবর্তীতে যদিও আমার আত্মীয়স্বজনরা জেনেছে। তারাই খাবার সরবরাহ থেকে শুরু করে সবকিছু করেছে। এক মাস পরে পুনরায় পরীক্ষা করার পর দেখলাম একইভাবে পজেটিভ আমি। পরপর তিনবার পজেটিভ হলাম। আমার একটু বেশি সময় লেগেছে। সুস্থ হওয়ার পরেও একটা সময় ভাইরাসটি শরীরের বিভিন্ন স্থানে থেকে যায়। আমার ইমিউনিটি কম থাকায় ভাইরাসমুক্ত হতে পারছিলাম না।

ঢামেকের ভাইরোলজি বিভাগের এই প্রধান বলেন, ভীষণভাবে সতর্ক থাকতাম যেন আমার দ্বারা আর কেউ আক্রান্ত না হয়। এই সময়টিতে আমি কিন্তু একটি দিনও ছুটিতে থাকিনি। প্রথম দশদিন বাসায় ছিলাম। তখন সারাক্ষণ অনলাইনে জুম মিটিং, ফোনে ইত্যাদিতে ডিউটি করেছি। দেখা গেছে, দুপুরের খাবার সন্ধ্যায় খেতে হয়েছে। এই সেবাটা দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। কারণ আমার বিকল্প কেউ ছিল না। তখন অক্সিমিটারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে নিলাম। চিকিৎসক হওয়াতে সুবিধা হয়েছে হাসপাতালে যেতে হয়নি। তখন করোনার অন্য কোনো উপসর্গ হয়নি। মনের জোরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম। আমি যেহেতু সংগীতপ্রেমী মানুষ। কঠিন এই সময়টাতে গান গেয়ে, বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে নিজেকে মানসিকভাবে ফিট রাখার চেষ্টা করেছি। এখন করোনা পরবর্তী যে সমস্যাটা হচ্ছে প্রচণ্ড ঘাড় ব্যথা এবং মাথা ব্যথা। তখন আমার ঘুম কম হতো। একদমই ঘুম হচ্ছিলো না। এখনো কম হয়। একমাত্র ছেলে ফাহাদ ইবনে আজম বিদেশে পড়ালেখা করছে। ফাহাদ যখন জানলো তখন একেবারেই অস্থির হয়ে পড়েছে। তখন সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আসতে পারবে না ভেবে খুব কষ্ট পাচ্ছিলো। ও শুধুমাত্র আমার ছেলে নয়, ভালো বন্ধুও বটে।   
         
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ফ্রন্টলাইনারদের মধ্যে প্রথম সারিতে চিকিৎসকরা। এই কথাটা অনেকে ভুলে যায়। পুলিশ, সংবাদকর্মীসহ আরো বেশকিছু পেশার মানুষ ফ্রন্টলাইনার হিসেবে এই মহামারিতে ভূমিকা রেখেছে এবং এখনো রাখছে। তারা কিন্তু জানেন না কে রোগী আর কে রোগী না। সুতরাং তারা সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ আমরা কিন্তু জেনে শুনে আক্রান্ত হচ্ছি। অনেকটা জেনে শুনে বিষ পান করা। এক্ষেত্রে তাদের এবং আমাদের মধ্যে একটু পার্থক্য থেকেই যায়। ব্যক্তিগতভাবে চাই এটুকু যেন আমরা একটু রিয়ালাইজড করি। কিন্তু কেউ করে না। এটা যেহেতু একটি শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস তাই কফ, থুথু, হাঁচি, কাশি ইত্যাদির মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়ায়। আমি বলবো যারা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন তারাও এতোটা ঝুঁকিগ্রস্ত না। অন্য সবাই হাঁচি, কাশি, থুথু থেকে সাবধান থাকছেন অথচ ল্যাবে সরাসরি সেটা নিয়েই আমরা কাজ করছি। চিকিৎসকদের মধ্যেও ল্যাবরেটরি পারসন প্রথম সারিতে আসবেন। অথচ আমরা সেই মূল্যায়নটা পাচ্ছি না। সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনার কথা বলা হলেও চিকিৎসকরা এখনো সেটা পায়নি। যেটা পেলে অনেক জুনিয়র চিকিৎসক উপকৃত হতেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn