কাজী সোহাগ-মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, রাজাকার পরিবারের সন্তান, জামায়াত-বিএনপি’র নেতা-কর্মী-সমর্থক, চালচোর, গমচোর, খুনের অভিযোগ, চাঁদাবাজ, আওয়ামী লীগ বিরোধী, ভূমিদস্যু, ধর্ষণের অভিযোগ, ইভটিজিংয়ে জড়িত- এমন অভিযোগ তুলে গত কয়েকদিনে প্রায় ৫শ’ চিঠি জমা পড়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে। একেক দিন একেক বিভাগের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনীত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ হয়েছে আর বেড়েছে চিঠির চাপ। অনেক চিঠিতে নানা ধরনের প্রমাণপত্রও তুলে ধরা হয়েছে। কোনো কোনো চিঠিতে এলাকাবাসীর স্বাক্ষরসহ দেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের এক কর্মী জানান, প্রতিদিন এক ইস্যুতে এত চিঠি আসছে যা সত্যিই অবাক হওয়ার মতো। কুরিয়ার, ডাকযোগের পাশাপাশি অনেকে মিছিল নিয়ে এসে চিঠি দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সবার দাবি একই। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেয়া প্রার্থী বাতিল করতে হবে।

এদিকে দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দল মনোনীত একক চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের করা অভিযোগ যাচাই- বাছাই করছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা। এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি ইউপিতে প্রার্থী বদল করা হয়েছে। শিগগিরই আরও কয়েকটি ইউপিতে প্রার্থী বদল করা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বলেন, যেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে অকাট্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তাদেরকে পরিবর্তন করা হচ্ছে। বিতর্কিতদের দলের মনোনয়ন দেয়া হবে না। তারা জানান, অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে তৃণমূল সংশ্লিষ্টদের। তবে সব অভিযোগের সত্যতা নেই। যারা মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন তাদের অনেকে মিথ্যা অভিযোগ কেন্দ্রে জমা দিচ্ছেন।

এদিকে তৃণমূলের নেতারা বলেন, তৃণমূলের দায়িত্বশীল এক শ্রেণির নেতারা অর্থের বিনিময়ে বিএনপি নেতা, রাজাকারের সন্তান-নাতি, বিতর্কিত বিত্তশালীর নাম গোপনে কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। ত্যাগীদের নাম পাঠাননি। এ কারণে বিতর্কিতরা মনোনয়ন পেয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপে আগামী ১১ই নভেম্বর ৮৪৮ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হবে। এতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ৪ হাজার ৪৫৮ জন। মনোনয়ন চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় গত ৮ই অক্টোবর।

এর আগে থেকেই দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দলের তৃণমূলে উত্তেজনা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় কেন্দ্রে অভিযোগ পড়তে শুরু করে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০শে অক্টোবর থেকে তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই করতে আবারও মনোনয়ন বোর্ডের সভা শুরু হবে। দলীয় মনোনয়ন প্রসঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক একাধিকবার সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,  ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে যেসব অভিযোগ সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে। সত্যতা প্রমাণ হলে প্রয়োজনে সংশোধন করা হবে। দলের মধ্যে অসুস্থ প্রতোযোগিতা, নেতৃত্বের জন্য ল্যাং মারামারি এসব বন্ধ করতে হবে। চা দোকানে বসে দলের এক নেতা আরেক নেতার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। এটা রাজনীতি না। ওবায়দুল কাদের বলেন, ইউপি নির্বাচনে বিভিন্ন জেলা থেকে দলীয় প্রার্থীর নাম পাঠানো হয়েছে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথ্য গোপন এবং নানা অনিয়ম ও জালিয়াতি করে কেন্দ্রে নাম পাঠিয়েছেন। যারা এ ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে, অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের এক সদস্য জানান, এতদিন তৃণমূলের প্রস্তাব ও সাংগঠনিকসহ বিভিন্ন সংস্থার জরিপ রিপোর্টের ভিত্তিতে ইউপিতে একক চেয়ারম্যান প্রার্থী চূড়ান্ত করত আওয়ামী লীগ। তৃণমূলের প্রস্তাবে কিছুটা সমস্যা থাকলে সাংগঠনিকসহ বিভিন্ন সংস্থার জরিপ রিপোর্ট দেখে মনোনয়ন দেয়া হতো। কিন্তু এবার সাংগঠনিকসহ বিভিন্ন সংস্থার জরিপ রিপোর্টেও বিতর্কিতদের নাম রয়েছে।

এদিকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে খুলনা বিভাগের নড়াইল জেলা সদরের বিছালী ইউনিয়ন পরিষদের প্রার্থী পরিবর্তন করে এসএম আনিসুল ইসলামকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এর আগে দুই ইউপি মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুরে এবং খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়ায় প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়। এদিকে ধানমন্ডি অফিসে জমা হওয়া বেশ ককেয়টি চিঠি এসেছে মিডিয়ার হাতে।

সেখানে কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়ীয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা মনোনীত প্রার্থী রাজাকার পরিবারের সন্তান বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ইউপি’র বর্তমান চেয়ারম্যান হাজী মো. আব্দুস সালাম আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে হাজী মো. আব্দুস সালাম বলেন, আসন্ন ফুলবাড়ীয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মো. আতাহার আলীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তিনি একজন রাজাকার পরিবারের সন্তান। মো. আতাহার আলীর পিতা প্রয়াত মনোয়ার হোসেন মুন্না ও বড় ভাই মরহুম শহর আলী তালিকাভুক্ত রাজাকার।

গত নির্বাচনে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নারিকেল গাছ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন এবং বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়িত থাকায় দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। অন্যদিকে আরেকটি চিঠিতে বলা হয়েছে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আশরাফুল হক। সেই আশরাফুল হককেই আসন্ন বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তার বাবা সিরাজুল হক উপজেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি ছিলেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, স্থানীয় এক সংসদ সদস্যের মাধ্যমে ছাত্রদলের পদে থেকেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আশরাফুল হক।

অন্যদিকে আরেক চিঠিতে অভিযোগ করে বলা হয়েছে-ইউরোপে বসেই নৌকা বাগিয়ে নিয়েছেন শাহ্‌ আলম মুন্সী। শরীয়তপুর জেলা সদর উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শাহ্‌ আলম মুন্সী। তিনি বর্তমানে ইউরোপের দেশ ইতালিতে বসবাস করছেন। পাশাপাশি তিনি বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ রয়েছে।

শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে যাদের নাম প্রস্তাব করেছিল, সেই তালিকায় শাহ্‌ আলম মুন্সীর নাম ছিল না। আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, দলীয় মনোনয়ন পেতে নিয়ম হলো, কারো পক্ষে ফরম যে কেউ সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু যিনি প্রার্থী তিনি নিজে মনোনয়ন ফরমে স্বাক্ষর করবেন এবং নিজে জমা দেবেন। এক্ষেত্রে ওই নিয়ম মানা হয়নি। এদিকে মনোনয়ন বঞ্চিত বেশ কয়েক ইউপি প্রার্থী বলেন, মন্ত্রী ও এমপিরা তাদের নিজেদের লোকদেরকে মনোনয়ন পাইয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। একে। সত্রে দলে কার কি ভূমিকা তা গুরুত্ব দেয়া হয়নি।

ওদিকে প্রার্থী বদল করা না হলে দেশের বেশ কয়েকটি ইউপি নেতারা বিদ্রোহী হিসেবে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কোথাও কোথাও প্রতিবাদে স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। আবার বেশকয়েক নেতা দল ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন। সবমিলিয়ে আসন্ন ইউপি নির্বাচন ঘিরে তৃণমূল আওয়ামী লীগে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn