আকবর আলি খান-

কথাটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে যে আইন, সেখানে সত্য মামলায়ও মিথ্যা সাক্ষী না দিলে শাস্তি দেয়া যায় না। মিথ্যা দিয়ে শুরু করা হয়, আর মিথ্যা দিয়ে শেষ করতে হয়। যে দেশের বিচার ও ইনসাফ মিথ্যার ওপর নির্ভরশীল সে দেশের মানুষ সত্যিকারের ইনসাফ পেতে পারে কি না সন্দেহ!’ আজ থেকে অনেক বছর আগে বিচারব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই উপলব্ধি আজও সেখানেই আছে। বৃটিশ বিদায়ে পাকিস্তান এসেছে। মুক্তিসংগ্রামের মধ্যদিয়ে  বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।

কিন্তু বিচারালয়ের অবস্থা কতটুকু বদলেছে? দিনবদলের ইতিহাসে নানা উত্থান-পতনে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এই সময়ে এখনও বিচারালয়ের দরোজায় ন্যায়বিচারের জন্য ঘুরছে মানুষ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত ঝঃধঃব ড়ভ এড়াবৎহধহপব ইধহমষধফবংয্থ-২০১৪/১৫ সালের প্রতিবেদনে সদ্য পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, ২৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৯৪টি মামলা জেলা আদালতে এবং ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯টি মামলা সুপ্রিম কোর্টে অনিষ্পন্ন। ২০১৬ সালের ১১ই জানুয়ারি বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশের আদালতগুলোয় ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন, এর মধ্যে ৩ লাখ উচ্চ আদালতে। আশঙ্কার জায়গা হচ্ছে- দিন যত যাচ্ছে মামলাজট ততই বাড়ছে। শুধু যে বাংলাদেশে এ চিত্র তেমনটি নয়। এটি পাশের দেশ ভারতেও। সেখানে বর্তমানে প্রায় ৩ কোটি মামলা বিচারাধীন। ২০০০ সালে অবিনাশ দীক্ষিত হিসাব করেছিলেন, যে হারে ভারতে বর্তমানে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে তাতে এসব মামলা নিষ্পত্তি হতে ৩২৪ বছর লাগবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের অনিষ্পন্ন মামলা নিষ্পত্তি করতে কয়েক শ’ বছর লেগে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অভিজ্ঞ আমলা ড. আকবর আলি খান তার সুলিখিত ‘অবাক বাংলাদেশ, বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ বইতে বিচারব্যবস্থার মূল সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে এর সমাধান খুঁজেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা। বিচারালয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতির উদাহরণ দিয়ে ব্যক্তিগত জীবন অভিজ্ঞতার আলোকে ড. আকবর আলি খান তার বইতে লিখেছেন, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে আইন পড়ি। সাক্ষ্য আইন আমাদের পড়াতেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ডিন ইমতিয়াজ আলী শেখ। তিনি ক্লাসে এসে একটি মামলায় সাক্ষীরা কী বলেছে, সেটার উদাহরণ দিয়ে তিনি এই মামলার ক্ষেত্রে বিচারক হিসেবে আমাদের রায় কী হবে, তা জানতে চান? তখন বয়স অল্প। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে দিলাম। জবাবটি শুনে অধ্যাপক মহোদয় হাসলেন এবং বললেন:
গু ফবধৎ ষবধৎহবফ ভৎরবহফ, ুড়ঁ ধৎব ঃযরহশরহম ঃযধঃ যিবহ ুড়ঁ রিষষ ংরঃ ধং ধ লঁফমব রহ ধ পড়ঁৎঃ, ড়হব ঢ়ধৎঃু রিষষ ঃবষষ ুড়ঁ ঃযব ঃৎঁঃয ধহফ ঃযব ড়ঃযবৎ ঢ়ধৎঃু রিষষ ঃবষষ ধ ষরব ধহফ ুড়ঁৎ লড়ন রং ঃড় ভরহফ ঃযব ঃৎঁঃয. ওহ ৎবধষ ষরভব ঃযরং রিষষ হবাবৎ যধঢ়ঢ়বহ. ইড়ঃয ঢ়ধৎঃরবং রিষষ পড়সব ধহফ ঃবষষ ষরবং. ণড়ঁৎ লড়ন রং ঃড় ভরহফ ঃযব ঃৎঁঃয ভৎড়স ঃড়ি ষরবং. ঞযরং রং ধহ বীঃৎবসবষু ফরভভরপঁষঃ লড়ন.
উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, ধরুন দুজন লোকের মধ্যে ঝগড়া হলো এবং এক পক্ষ আরেক পক্ষকে গালিগালাজ করলো। তারপর ক্ষুব্ধ পক্ষ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উকিলের কাছে গেল। উকিল বলবেন, গালাগালির জন্য মামলা করলে আসামিকে যথেষ্ট শাস্তি দেওয়া যাবে না। শাস্তি দিতে হলে তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ছুরি দিয়ে আঘাত করার মামলা করতে হবে। তিনি তার মক্কেলকে ব্লেড দিয়ে হাতে একটু আঘাতের সৃষ্টি করতে বললেন ও তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। চিকিৎসক ঘুষ খেয়ে সার্টিফিকেট দিলেন যে প্রতিপক্ষ বাদীকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। প্রতিপক্ষ যখন জানলো যে তার বিরুদ্ধে ছুরি দিয়ে আঘাত করার মামলা করা হয়েছে তখন সে তার উকিলের কাছে যায়। উকিল তাকে পরামর্শ দেন, এই ক্ষেত্রে তার বক্তব্য হবে যে সে সেদিন ঢাকা শহরেই ছিল না, ময়মনসিংহ শহরে ছিল। সে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য কয়েকজন ময়মনসিংহবাসীকে ঠিক করার ব্যবস্থা করলো। আদালতে যখন মামলা উঠলো, তখন বাদীপক্ষ দাবি করলো, আসামিপক্ষ একটি ধারালো ছুরি দিয়ে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বাদীকে আক্রমণ করেছিল। আর আসামিপক্ষ দাবি করলো যে, ঘটনার দিন সে ঢাকা শহরেই ছিল না, ময়মনসিংহ শহরে ছিল। ময়মনসিংহ শহরের কয়েকজন বাসিন্দা এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। দুই পক্ষই মিথ্যা কথা বললো। অথচ ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এই পরিস্থিতিতে বিচারকের পক্ষে সত্য এবং মিথ্যার ফারাক করা শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।
ড. আকবর আলি খান লিখেন, দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে এখনো এই বিচারব্যবস্থাই চলছে, যেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাষায় মামলা মিথ্যা দিয়ে শুরু করা হয় আর মিথ্যা দিয়ে শেষ করতে হয়। এ ধরনের বিচারব্যবস্থা শুধু মানুষের অধিকারই ক্ষুণ্ন করছে না, দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট করছে। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংক বিনিয়োগকারীদের গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থার মূল্যায়ন করে। এই মূল্যায়নে দেখা যায় যে ৮৩ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীর বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ওপর কোনো আস্থা নেই। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংকের আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যায়, যদি কোনো চুক্তি নিয়ে বিবাদ হয়, তাহলে আদালতের মাধ্যমে চুক্তি বলবৎ করতে সারা বিশ্বে গড়ে ৬১৩ দিন লাগে। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে লাগে ১৪৪২ দিন। অর্থাৎ সারা বিশ্বে যে সময় লাগে, তার দ্বিগুণের বেশি সময় লাগে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল জানাচ্ছে, তাদের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে সমীক্ষাভুক্ত ব্যক্তিদের ৬৬ শতাংশ আদালতের নিচের পর্যায়ে গড়ে ৬১৩৫ টাকা ঘুষ দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আইনগত এবং বিচারিক ক্ষমতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত প্রকল্পের মূল্যায়ন দলিল থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে একটি দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হতে ১৫ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। আসলে এই সময় আরও অনেক বেশি। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা বর্তমানে এক চরম সংকেটর সম্মুখীন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn