কাজী জেবেল-

দেশের নয় কোটি নাগরিকের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেয়ার প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে স্মাটকার্ড প্রক্রিয়াকরণ (পারসোনালাইজেশন) কার্যক্রম। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের অবার্থুর টেকনোলজিসের (ওটি) ব্যর্থতায় আইডিইএ (আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর ইনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস) প্রকল্পটির এ অবস্থা হয়েছে। এর মাধ্যমে লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্রের বদলে এই স্মার্টকার্ড দেয়ার কথা।
৩০ জুনের মধ্যে নয় কোটি স্মার্টকার্ড বিতরণের কথা ছিল। ৮১৬ কোটি টাকায় চুক্তির আড়াই বছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ২৫ লাখ ৭০ হাজার নাগরিকের হাতে স্মার্টকার্ড পৌঁছাতে পেরেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এ পর্যন্ত ১ কোটি ২৪ লাখ কার্ড প্রস্তুত করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এসব মিলে ১৭ শতাংশের কম কাজ করে ৫০ ভাগের বেশি (৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি) বিল নিয়ে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এ পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। খুব শিগগিরই কমিশন থেকে এ সংক্রান্ত ঘোষণা আসতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে এসব তথ্য।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ওটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির মাধ্যমে স্মার্টকার্ড উৎপাদনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। প্রকল্পের আওতায় কেনা ১০টি মেশিনেই এসব কার্ড প্রক্রিয়াকরণ করা হবে। সেক্ষেত্রে রাজস্ব খাত থেকে ব্যয় বহন করার চিন্তা করা হচ্ছে।
ইসি ও আইডিইএ প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, নয় কোটি মানুষের হাতে কার্ড তুলে দিতে চুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিল ওটি। প্রকল্পের স্বার্থে ডিসেম্বর পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য নানান ধরনের সমঝোতামূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। কার্ড প্রক্রিয়াকরণে ৮টি অতিরিক্ত মেশিন আমদানি, নতুন ওয়ার্কিং প্ল্যান তৈরিসহ ওই কোম্পানিকে দেয়া হয় কয়েকটি শর্ত। কিন্তু প্রাথমিক ধাপের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় সেই প্রক্রিয়াও ভেস্তে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। ইতিমধ্যে কোম্পানির কিছু বিল আটকে দেয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে মূল প্রকল্প আইডিইএর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ওই সময়ের পর এ প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়বে না বলে ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত কমিটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সম্ভবত এক সপ্তাহের মতো কার্ড উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। দেশের স্বার্থে ওই কোম্পানিকে আমাদের ডাটাবেজে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সময়মতো কার্ড ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় চুক্তির মেয়াদ হয়তো বাড়াব না। তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ আদায়সহ অন্যান্য আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির এক সভায় শর্তসাপেক্ষে মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু তারা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা বাস্তবায়ন করেনি উল্টো নির্বাচন কমিশনকে নানান শর্তারোপ করায় প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির অপর সভায় চুক্তির মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।অবার্থুর টেকনোলজিসের ব্যর্থতার বিষয়ে এ প্রজেক্টের অপারেশনবিষয়ক কনসালটেন্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। কেন যথাসময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি সে বিষয়ে জানতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওটির সদর দফতর ফ্রান্সের ঠিকানায় দুই দফা ই-মেইল করা হয়। প্রথম দফায় বুধবার এবং দ্বিতীয় দফায় শুক্রবার। কিন্তু শনিবার পর্যন্ত তারা কোনো জবাব দেয়নি।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, চুক্তি অনুযায়ী ব্ল্যাঙ্ক কার্ড আমদানি করে বাংলাদেশে স্থাপিত মেশিনে তা প্রক্রিয়াকরণ (পারসোনালাইজেশন) করা হবে। এরপর তা থানা ও উপজেলা পর্যায়ে ভোটারদের হাতে তুলে দেয়ার কথা। এসব কাজের পুরোটাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের করার কথা। এমন বিধান রেখে ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি ফ্রান্সের ওটির সঙ্গে ১০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৮১৬ কোটি টাকার) চুক্তি করে ইসি। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ৯ কোটি মানুষের হাতে এ কার্ড তুলে দেয়ার কথা ছিল। পরে এই মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। চলতি বছরের ৩০ জুন সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে। চুক্তির পর থেকেই প্রতি ধাপে এ কোম্পানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ৩ জুলাই ইসি সচিবকে দেয়া এক চিঠিতে আইডিইএ প্রকল্পের পরিচালক স্মার্টকার্ডের অগ্রগতি সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরেন। এতে উল্লেখ করা হয়, এ পর্যন্ত ৯ কোটি ভোটারের মধ্যে ২৫ লাখ ৭০ হাজার (২.৫৭ মিলিয়ন) মানুষকে এ কার্ড দেয়া হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। থানা ও উপজেলা পর্যায়ে ১ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার (১০.৯৮ মিলিয়ন) কার্ড পৌঁছানো হয়েছে, কিন্তু বিতরণ করা হয়নি। কার্ড প্রক্রিয়াকরণ (পারসোনালাইজেশন) করা হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ ১০ হাজার (১২.৪১ মিলিয়ন), যা লক্ষ্যমাত্রার ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ফ্রান্স থেকে এ পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্ক কার্ড এসেছে ৬ কোটি ৬৩ লাখ ৬০ হাজার (৬৬.৩৬ মিলিয়ন), যা লক্ষ্যমাত্রার ৭৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আরও ২.৯৫ মিলিয়ন কার্ড পাইপলাইনে রয়েছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। অপর এক সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিল নিয়েছে এ কোম্পানিটি। আরও কমবেশি ৩০ মিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে। ওই টাকা পরিশোধ বন্ধ রয়েছে। বাকি ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাজই করেনি প্রতিষ্ঠানটি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসির কর্মকর্তারা জানান, কার্ড উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকেই ওই কোম্পানির কাছে জিম্মি ছিলেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। কোম্পানিটি চুক্তি অনুযায়ী মেশিন আনলেও ডকুমেন্ট হস্তান্তর করেনি। কার্ড প্রক্রিয়াকরণের বিষয়ে প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের কোনো প্রশিক্ষণ দেয়নি। বর্তমানে ওইসব মেশিনারিজ অবার্থুর টেকনোলজির ব্যবসায়িক অংশীদার টাইগার আইটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর বাইরে প্রকল্পের আওতায় ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কসহ (ভিপিএন) অন্যান্য উপখাতের কার্যক্রমেও গতি নেই।

আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর ইনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এখনও কিছু জিনিসপত্র সাপ্লাই দেয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ কারণে কার্ড প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২৮ মাসে মাত্র ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ কাজ করেছে। এভাবে ধীরগতিতে কাজ করবে, দেশের জনগণকে জিম্মি করে রাখবে তা আমরা সহ্য করব না। ২৮ মাসে এ কোম্পানি কী কাজ করেছে তার কৈফিয়ত চেয়েছি। তাদের বলেছি, এর জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

ইসি সূত্রে আরও জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চুক্তি লংঘনের বিষয়ে সম্প্রতি কমিশনের সামনে একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন আইডিইএ প্রকল্পের কর্মকর্তারা। এতে যেসব অনুচ্ছেদে চুক্তি লংঘনের ঘটনা ঘটেছে তার বিবরণ দেয়া হয়েছে। এতে জানানো হয়, চুক্তির পর থেকেই কার্ড আমদানিতে ধীরগতি ছিল। ২০১৫ সালে ২.১৮ মিলিয়ন, ২০১৬ সালে ৯.৫ মিলিয়ন ও ২০১৭ সালে ৪৫.৮২ মিলিয়ন সবমিলিয়ে ৫৭.৫০ মিলিয়ন কার্ড আমদানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি অনুযায়ী ওয়ারেন্টির সময়ে সব ধরনের হার্ডওয়্যার, রিপেয়ার, রিপ্লেসমেন্টসহ অন্যান্য বিষয় নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। কার্ড প্রক্রিয়াকরণের সব পর্যায়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়ন করেনি ওটি। কার্ড প্রক্রিয়াকরণে মেশিনারিজের পারফরম্যান্সও ভালো ছিল না- এমন তথ্য উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতিদিন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৬টি কার্ড প্রক্রিয়াকরণ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে গড়ে ৪৫ হাজার কার্ড প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরও কয়েকটি অনুচ্ছেদ লংঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

আইডিইএ প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দীন বলেন, কাজের গতি বাড়াতে বারবার তাগিদ দিয়েছি। কিন্তু লাভ হল না। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী এ কোম্পানি থেকে পেনাল্টি আদায়ের সুযোগ রয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn