হোসেন তওফিক চৌধুরী –

সুনামগঞ্জের এক বহুমাত্রিক প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবদুল হাই। তিনি একাধারে ছিলেন ভাষা সৈনিক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক নেতা, পথিকৃত সাংবাদিক-সাহিত্যিক, সাহিত্য সংগঠক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অভিনয় শিল্পী, সমাজসেবক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ১৯২৯ সালে সুনামগঞ্জের আরপিননগরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। ১৯৮৩ সালে ২৫ শে এপ্রিল মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৩৬ বছর পর ‘সময়ের স্মৃতিতে বহুমাত্রিক প্রতিভা মুহাম্মদ আবদুল হাই’ নামে একটি স্মারক গ্রন্থ বেরিয়েছে। তাঁর ৯২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই স্মারকগ্রন্থের প্রকাশ। তাঁর ভাগ্নে ইমানুজ্জামান মহী স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক। প্রকাশক তাঁর ভাতিজা আনোয়ার চৌধুরী আনুল। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। সিলেটের চৈতন্য প্রকাশনী থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে।

গ্রন্থটিতে ‘দেখা ও জানা থেকে লেখা স্মরণ কথন’ ‘দুটো কবিতা’ এবং ৩৪ জন লেখকের বিভিন্ন আঙ্গিকের লেখা স্থান পেয়েছে। ৪৯৬ পৃষ্ঠার বিশাল স্মারকগ্রন্থে জীবনালেখ্য, সম্মাননা ও স্বীকৃতি, জনমত ও আব্দুল হাই, সুনামগঞ্জের তালুকদার বাড়ির ইতিহাস, আব্দুল হাইর সৃষ্টি, উত্তাল তরঙ্গে গানের সংকলন এবং উতলা বাতাসে স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটিতে কয়েকটি দুর্লভ আলোকচিত্র রয়েছে।

প্রগ্রতিশীলতা, মুক্তিযুদ্ধের চর্চা, শিক্ষার বিস্তার, মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, মহান মুক্তিযুদ্ধ-সকল ক্ষেত্রে শুধু অংশগ্রহণ নয়, তিনি ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। সামনের সারির সুযোগ্য দিশারী, কিন্তু তাঁর সম্পর্কে স্মারক গ্রন্থ প্রণয়নে তাঁর সময়ের কোন ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায় নি। তাঁদের প্রায় সকলেই ইতিপূর্বে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। ফলে যারা তাঁকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন বা যারা তাঁর সাথে একাত্ত হয়ে কাজ করেছেন তাঁদের স্মৃতিমূলক কোন রচনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তবুও এই আলোচ্য গ্রন্থে যারা লিখেছেন তাঁদের রচনায় আবদুল হাইর জীবন চিত্র ও অবদান মোটামুটি বিধৃত হয়েছে।

গ্রন্থটিতে কবিতা লিখেছেন মোহাম্মদ সাদিক ও ব্রজেন্দ্র দাস। মুহাম্মদ আব্দুর রহিম (শিক্ষক), মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ (শিক্ষাবিদ), হোসেন তওফিক চৌধুরী, গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেশী, হাসান শাহরিয়ার, আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন, দেওয়ান মহসিন রাজা, নজীর হোসেন, স্বপন কুমার দেব, শাহগীর বখত ফারুক, সুজাত আহমদ চৌধুরী, নুরুজ্জামান শাহী, সুখেন্দু সেন, আল আজাদ, মুতাসিম আলী, আব্দুস শহীদ, নিরঞ্জন দাস, রবিউল লেইছ রোকেস, শহীদুজ্জামান চৌধুরী, ইকবাল কাগজী, সৈয়দ মুহিবুল ইসলাম, জেসমিন আরা বেগম, সুজাত মনসুর, ইমতাদুজ্জামান (চুন্নু), কুমার সৌরভ, আবুল মকসুদ, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, ফাতেমা চৌধুরী স্বপ্না, মোহাম্মদ মোরশেদ আলম, পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, শাহরিয়ার বিপ্লব, রাজিব বাসিত, তুলিকা ঘোষ এবং রুমানা জামান প্রমুখ লিখেছেন। জীবনালেখ্য লিখেছেন ইমানুজ্জামান মহী ও আল হেলাল।

সম্মানিত লেখকদের রচনায় শুধুমাত্র আবদুল হাইর জীবনের নানা কথা ও অধ্যায় ফুটে উঠা ছাড়াও সমসাময়িক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব স্থান পেয়েছে। এই স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের ফলে বিস্মৃতির করাল গ্রাস থেকে কিছু অধ্যায় রক্ষা পেয়েছে। বিস্মৃতি আমাদের ইতিহাসে সোনালী অধ্যায়ের অংশগ্রলোকে গ্রাস করতে পারেনি। সুনামগঞ্জে ইতোমধ্যেই কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে স্মারক গ্রন্থ বেরিয়েছে। রাজনীতিবিদ মুনাওয়ার আলী, সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ মকবুল হোসেন চৌধুরী, আব্দুজ জহুর, প্রসুন কান্তি বরুন রায়, হোসেন বখত, দেওয়ান মমিনুল মউজদীন, আয়ুব বখত জগলুল, আলফাত উদ্দিন আহমদ, আব্দুল মজিদ মাস্টার, অধ্যাপক আব্দুল বারী, আসদ্দর আলী চৌধুরী প্রমুখের জীবন ও সময় নিয়ে স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি স্মারক গ্রন্থেই ইতিহাসের অনেক উপাদান রয়েছে। এসবের ফলে সুনামগঞ্জের হারিয়ে যাওয়া সোনালী অধ্যায়ের গৌরবদীপ্ত অতীত পরিস্ফূট হয়েছে। তাই বলা চলে ব্যক্তি বিশেষ নিয়ে স্মারকগ্রন্থের প্রয়োজন বিরাজমান।

প্রতিভাশালী আবদুল হাই যিনি নিজেকে ‘হাছন পছন্দ’ বলে পরিচিত হয়েছেন তাঁর উপর স্মারক গ্রন্থটি প্রকাশ করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁর ভাগ্নে ও ভাতিজা। সম্মানিত লেখকরা স্মারকগ্রন্থের সারগর্ভ রচনা প্রণয়ন করে স্মারক গ্রন্থটির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছেন। গ্রন্থটিতে সামান্য ভুলভ্রান্তি রয়েছে। ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে তা বিবেচনায় নিতে হবে। স্মারক গ্রন্থটি সকল মহলে সমাদৃত হবে এবং ভবিষ্যতে সুনামগঞ্জের ইতিহাস প্রণয়নে সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : আইনজীবী-কলামিষ্ট

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn