আলী রীয়াজ- যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর গত বুধবার বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসার ব্যাপারে যে ‘নতুন ভিসা নীতি’ ঘোষণা করেছে, তার লক্ষ্য বিষয়ে কোনো রাখঢাক করা হয়নি, এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে’ এই নতুন নীতি ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর লক্ষ্য হচ্ছে ‘যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায়, তাদের সবাইকে সমর্থন’ দেওয়া।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যদি সরকারের দাবি অনুযায়ী দেশে ইতিমধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা চালু এবং অনুকূল পরিস্থিতি বজায় থাকত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের নতুন নীতি ঘোষণা করার প্রয়োজন বোধ করত না, এ নিয়ে আলোচনারও দরকার হতো না। এই নতুন নীতিতে বলা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বলে বলা হয়েছে।

যদিও পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার ওয়াশিংটনে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এবং সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশি সম্প্রচারমাধ্যম চ্যানেল আইয়ের টক শো অনুষ্ঠান ‘তৃতীয় মাত্রা’য় সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে এর লক্ষ্য কেবল সরকার নয়, সরকারবিরোধীদের জন্যও এই নীতি প্রযোজ্য হবে। কিন্তু যে চারটি কারণে ভিসা দেওয়া হবে না বলে বলা হচ্ছে, তার অধিকাংশই সরকারের দিকেই অঙ্গুলিসংকেত করে। যে চার কাজের কারণে ভিসা দেওয়া হবে না, সেগুলো হচ্ছে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারচর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান এবং রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড।

ডোনাল্ড লু সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ সরকারকে এই বিষয়ে অবহিত করেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে ৩ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফর করছিলেন এবং ৪ মে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ নবম অংশীদারত্ব সংলাপ। ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলে ডোনাল্ড লু ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত এই নীতির তিনটি দিক আমাদের মনোযোগ দাবি করে। প্রথমত, আলাদা করে এই নীতি ঘোষণা করা। দ্বিতীয়ত, এই নীতির পরিধি। তৃতীয়ত, এই নীতি ঘোষণার আগের ঘটনাপ্রবাহ।

যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের একটি বিশেষ ধারা [২১২ (এ) (৩) ] অনুযায়ী এই নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। আইনের এই ধারার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে।এর জন্য সরকারের আলাদা করে কোনো ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অতীতে কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘোষণা দিয়েছে। এই বছরের ১৫ মে নাইজেরিয়ার নির্বাচনের ব্যাপারে এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে উগান্ডার নির্বাচনের পরে ওই দেশের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এই একই ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ব্যাপারে এই ধরনের ঘোষণাকে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে অভূতপূর্ব বলে মনে করার কারণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক কারণে কোনো দেশের কাছ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ মোকাবিলা করতে হয়নি।

অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে ঘটনার পরে। নাইজেরিয়া ও উগান্ডার ক্ষেত্রে নির্বাচন হওয়ার পরে এসব দেশের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নীতি ঘোষণা করা হলো সম্ভাব্য নির্বাচনের অন্তত সাত মাস আগে। যার অর্থ হচ্ছে এই যে নির্বাচনের আগেই যদি কোনো পক্ষ নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করে, তবে তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যবস্থা নিতে দ্বিধান্বিত হবে না। পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মিলার বলেন, এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি ‘সিগন্যাল’ যে আমরা কেবল অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা সমর্থন করব। এ ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত (রেডি টু টেক অ্যাকশন)।

এই নীতির দ্বিতীয় দিক হচ্ছে এর পরিধির ব্যাপকতা। এতে নির্বাহী বিভাগ ও ক্ষমতার বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কথাই কেবল বলা হয়নি, এতে বিচার বিভাগের কথাও বলা হয়েছে।  এই নীতির ব্যাপকতার আরেকটি দিক জানা যায় ডোনাল্ড লুর বক্তব্যে। তিনি বলেছেন যে ভিসা নীতিতে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া ব্যক্তিদের নির্দেশদাতারাও এই নীতির মধ্যে পড়বেন। তাঁদের জন্যও ভিসা নিষেধাজ্ঞা হতে পারে। এই ধরনের ব্যাপক নীতির বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কারা এই ধরনের কাজে যুক্ত আছেন, তাঁদের শনাক্ত করা, কিন্তু তাঁদের নির্দেশদাতাদের খুঁজে পাওয়া ততটা কঠিন হবে বলে মনে হয় না। এই নীতি ঘোষণা করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ সরকারকে এই নীতির কথা ৩ মে জানানো হয়েছে।

 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন যে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তাঁকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তিনি দেশে ফিরে ১৫ মে বলেন, যারা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেসব দেশ থেকে কোনো রকম কেনাকাটা করবে না বাংলাদেশ; অর্থ মন্ত্রণালয়কে তিনি এই বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, একই সময়ে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতের বিশেষ নিরাপত্তা–সুবিধা তথা সার্বক্ষণিক পুলিশ এসকর্ট প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলা হয়। এই ঘটনাগুলো যেহেতু ঘটেছে মার্কিন নীতি জানার পরে, এগুলোকে সরকারের একধরনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বলেই বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে লক্ষণীয় যে আনুষ্ঠানিকভাবে এই নীতি ঘোষণার পরে সরকার যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, সেখানে নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন যে এই নীতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো বিরোধ নেই। তাই যদি হয়, তবে ৩ মের পরের কথাবার্তাগুলো কোন বিবেচনা থেকে বলা হয়েছিল—সেই প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন।

আলী রীয়াজ-যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn