চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রী যৌন নিপীড়নে জড়িত দুই শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ, রেসিডেন্স ও ডিসিপ্লিনারি কমিটির সভায় শনিবার বিকেল পাঁচটার দিকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। বহিষ্কার হওয়া দুই ছাত্র হলেন, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আজিম হোসাইন ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুরুল আবসার বাবু। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিসিপ্লিনারি কমিটির সদস্য সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়া।

তিনি বলেন, ‘তথ্য উপাত্ত, র‍্যাবের প্রেস ব্রিফিং, তদন্ত কমিটির ইন্টারনাল প্রতিবেদন, সিনেটদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে দুই ছাত্রকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। বাকি যারা আছেন তাদের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর শাস্তির সুপারিশ করা হবে। এ ছাড়া কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে।’ গত ২০ জুলাই বিকেলে হাটহাজারী থানায় যৌন হেনস্তার অভিযোগে অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচজনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন ওই ছাত্রী। এজাহারে পথরোধ করে মারধর, ছিনতাই ও অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে হুমকি দেয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে।

আগের দিন গত ১৯ জুলাই প্রক্টরের কাছে হেনস্তার লিখিত অভিযোগ করেন চবির ওই ছাত্রী। এতে তিনি জানান, ১৭ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি ও তার বন্ধু প্রীতিলতা হলে ফেরার সময় কাছের একটি সড়কে কয়েক যুবক তাদের পথরোধ করেন। তাদের মারধর করে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনে ঝোপে নিয়ে যান যুবকরা। ছাত্রীর দাবি, তাকে বিবস্ত্র করে মোবাইলে ভিডিও করা হয় এবং সেই ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান যুবকরা। তার বন্ধু এর প্রতিবাদ করলে তার ওপরও নির্যাতন করা হয়। পরে যুবকরা দুজনের মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনতাই করে পালিয়ে যান।

এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। এ বিষয়ে র‍্যাব-৭-এর চান্দগাঁও ক্যাম্পে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ ভুক্তভোগীর অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ছয়জন জড়িত। তারা ছাত্রীকে মারধরের পর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণেরও চেষ্টা করেন। র‍্যাব অধিনায়ক বলেন, ‘তারা তিনটি মোবাইলে ভিডিও ধারণের চেষ্টা করেন। এর মধ্যে দুটি মোবাইল ওই ছাত্রী ও তার ছেলে বন্ধুর। অন্যটি ঘটনার হোতা আজিম হোসাইনের। আজিম নিজের মোবাইল দিয়ে ভিডিও ধারণের কথা স্বীকার করেছেন।’ র‍্যাব কর্মকর্তা এম এ ইউসুফ বলেন, ‘শুক্রবার ঘটনার মূল অভিযুক্ত আজিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং স্থানীয়। তার নেতৃত্বে পুরো ঘটনা ঘটেছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর আমরা বাকিদের নাম পাই।’

যেভাবে যৌন নিপীড়ন

র‍্যাব-৭-এর অধিনায়ক বলেন, ‘অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলে আমরা জানতে পেরেছি, সেদিন রাত ১০টা-সাড়ে ১০টার দিকে ওই ছাত্রী তার এক ছেলে বন্ধুসহ হলের দিকে ফিরছিলেন। আজিম ও তার গ্রুপটি মোটরসাইকেল নিয়ে রাতে ঘোরাঘুরি ও আড্ডা দিতে থাকে। মোটরসাইকেল দুটি ছিল সাইফুল ও শাওনের। ঘোরাঘুরির সময় হঠাৎ তাদের নজরে আসে, একটি ছেলে ও একটি মেয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিক থেকে হেঁটে আসছে, জায়গাটি একটু নির্জন। শুরুতে তারা গিয়ে ভুক্তভোগীদের চার্জ করেন। ছাত্রীর ছেলে বন্ধুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন না। অভিযুক্তরা তাদের কাছে গিয়ে এত রাতে বাইরে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করেন। ছেলে বন্ধুর কাছে দাবি করা হয় চাঁদা। একপর্যায়ে তাদের মোবাইল কেড়ে নেয়া হয়।

‘তখন তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। পরে ছয়জন তাদের ওপর আরও বেশি চড়াও হয়। ছেলেটিকে আটকে রেখে মেয়েটিকে তারা নির্যাতন করে। প্রথমে চড়-থাপ্পড় মারে, তারপর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের চেষ্টা করে।’ ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ভ্যানিটি ব্যাগ ও টাকা পয়সা নিয়ে নেয়ার পর তারা (জড়িতরা) ঘটনাস্থল ত্যাগ করে জানিয়ে র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘তখন ভুক্তভোগীরা একটি হলে গিয়ে এক ছাত্রের মোবাইল থেকে ফোন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অভিযোগ জানায়।’ ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত না দাবি করে তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাইনি। যার নেতৃত্বে ঘটনা ঘটেছে, আজিম, সে অকপটে বলেছে, ঘটনাটি ঘটেছে তাৎক্ষণিক। কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না বা মেয়েটিকে টার্গেট করার কোনো প্ল্যান ছিল না। এমনকি মেয়েটিও আমাদের বলেছে, সে আজিমকে আগে থেকে চিনতো না।’

আজিমের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আজিম যেহেতু এলাকায় অবস্থান করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, এই কারণে এলাকায় তার প্রভাব ছিল। এই প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে সে হয়তো ছোটখাটো কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জেনেছি। এগুলো তদন্ত করে আমরা বের করব।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অভিযুক্ত সবাই বলছে তারা ছাত্রলীগ সমর্থন করে। সমর্থন তো যে কেউ করতে পারে। কিন্তু তাদের কোনো পদ-পদবি নেই। তারা যেটা বলছে যে, তাদের মধ্যে দুই গ্রুপেরই সমর্থক রয়েছে। এখানে নির্দিষ্ট কোনো গ্রুপের কেউ না। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী একেক জন একেক গ্রুপ সমর্থন করে। সমর্থন করা মানেই আমি বলতে পারি না যে, তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সমর্থন তো যে কেউ করতে পারে, জনসাধারণ হিসেবে তার অধিকার রয়েছে।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn