শরীফ নাসরুল্লাহ- বাড়ি থেকে পালিয়ে, গুপী গাইন বাঘা বাইন, ছুটির ঘণ্টা, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী কিংবা সোনার কেল্লা—শৈশবের রঙিন দিনগুলো এসব চলচ্চিত্রে ভেসে ওঠে। আরও আছে হোম অ্যালোন, ইটি দ্য এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল-এর মতো ছবি। শিশুমন, কল্পনা ও চারপাশের জগৎ নিয়ে তৈরি এসব ছবি। শিশুদের সুস্থ বিনোদনের কথা মাথায় রেখে হ্যারি পটার সিরিজের মতো চলচ্চিত্র বা অ্যানিমেটেড ছবি হচ্ছে হলিউডে। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্রটি বেশ হতাশাজনক। স্বাধীনতার পর থেকে এখানে শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র হয়েছে হাতে গোনা। বর্তমানে বছরে অনুদানের একটি ছাড়া শিশুদের জন্য আর ছবি তৈরি হয় না। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, শিশুমন নিয়ে অভিভাবকদের অসচেতনতা এ ধরনের ছবির বাজার তৈরি না হওয়ার একটি বড় কারণ। আরও আছে মানসম্পন্ন পাণ্ডুলিপির অভাব এবং পুরো চলচ্চিত্রশিল্পের তথৈবচ অবস্থা। কয়েকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আজিজুর রহমানের ছুটির ঘণ্টা, বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, মোরশেদুল ইসলামের দীপু নাম্বার টু ছবি। আশি ও নব্বইয়ের দশকে আরও কয়েকটি ছবি বেশ আলোচিত হয়। এর মধ্যে ছিল শেখ নজরুল ইসলামের এতিম মাসুম, সি বি জামানের পুরস্কার। এ সময় আরও কিছু ছবি তৈরি হয়েছিল। যেমন সুভাষ দত্তের ডুমুরের ফুল,  শহীদুল আমিনের রামের সুমতি

একমাত্র মোরশেদুল ইসলাম ধারাবাহিকভাবে শিশুদের ছবি বানিয়ে গেছেন। দীপু নাম্বার টুর পর করেছেন দূরত্ব, আমার বন্ধু রাশেদ, আঁখি ও তার বন্ধুরা ছবিগুলো। কিন্তু এই চলচ্চিত্রকারও পুরো ব্যাপারটি নিয়ে হতাশ। তিনি বলেন, ‘শিশুদের ছবি কেউ দেখে না। দর্শক নেই বললেই চলে। এমন চললে কাজ করা ছেড়ে দিতে হবে।’ নব্বইয়ের দশকের পর থেকে শিশুদের ছবি নির্মাণ একেবারে কমে যায়। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে কয়েকটি ছবি নির্মিত হলেও এফডিসিতে তেমন ছবি তৈরি হয়নি। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘বাণিজ্যিক ছবিই কম তৈরি হচ্ছে, একই কারণে বাচ্চাদের ছবিও কম তৈরি হচ্ছে। তা ছাড়া ৩৫ মিলিমিটার থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে ছবি নির্মাণের একটা রূপান্তর হচ্ছে। এ কারণেও ছবি কমেছে।’  শিল্পকলা একাডেমির সহায়তায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কয়েকটি চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান দিয়েছিল। টোকন ঠাকুরের রাজপুত্তুর ও সুমনা সিদ্দিকীর মাধো এমন অনুদান পাওয়া ছবি। একটা সময় বাংলাদেশ শিশু একাডেমী থেকে খান আতাউর রহমানের ডানপিটে ছেলে, শেখ নেয়ামত আলীর রানিখালের সাঁকো, বাদল রহমানের ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ–এর মতো ছবি হয়েছিল। কিন্তু বাজেটস্বল্পতার কারণে পরে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০০৭ সালের দিকে ইউনিসেফের সহযোগিতায় শিশুদের জন্য কর্মশালা ও চলচ্চিত্র নির্মাণের আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়।

প্রকল্পটির মাধ্যমে শিশুরাই গল্প বাছাই করে ছবি বানানো শেখে ও বানায়। শিশুদের এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়। কিন্তু শিশুদের জন্য পেশাদারি চলচ্চিত্র নির্মাণ এতে সম্ভব হচ্ছে না। শিশু একাডেমীর লাইব্রেরি–প্রধান রেজিনা আখতার বলেন, ‘শিশুদের জন্য তো কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। ওদের মনন বিকাশের জন্যই ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা দরকার। এর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও জরুরি।’ প্রতি অর্থবছরে চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে একটি শিশুতোষ ছবিকে অনুদান দেওয়ার কথা। এভাবে মানিক মানবিকের শোভনের স্বাধীনতা, মান্নান হীরার একাত্তরের ক্ষুদিরামসহ বেশ কয়েকটি ছবি নির্মিত হয়েছে। তবে এগুলোর প্রচার ও প্রসার তেমন ছিল না। আবার ভালো পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায় না অনেক সময়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহীন আরা বেগম বলেন, ‘পাণ্ডুলিপি মানসম্পন্ন না হলে কমিটি অনুদান না–ও দিতে পারে। শিশুদের জন্য চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি জমাও পড়ে কম।’ আছে দক্ষ পরিচালকের অভাব। ছবি দেখানোর জন্য বেশি প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া যায় না। এরপরও কিছু কাজ হচ্ছে। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে সারা দেশে চলচ্চিত্র উৎসব হয়। তা ছাড়া প্রতিবছর চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটির আয়োজনে আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে দেশি-বিদেশি ছবি দেখার সুযোগ পায় শিশুরা।

এখানে শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র হয়েছে হাতে গোনা।
শিশুদের ছবি কেউ দেখে না। দর্শক নেই বললেই চলে।
☀  বাণিজ্যিক ছবিই কম তৈরি হচ্ছে, একই কারণে বাচ্চাদের ছবিও কম তৈরি হচ্ছে।
☀  শিশুতোষ চলচ্চিত্রের জন্য আছে দক্ষ পরিচালকের অভাব।
☀  শিশুদের মনন বিকাশের জন্যই ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা দরকার।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn