চন্দন দাস এর ফেসবুক পেইজ থেকে-

১৫ আগষ্ট ১৯৭৫। বাঙ্গালী জাতীর জীবনের এক কালো অধ্যায়। এ দিন সংগঠিত হয় পৃথিবীর সব চেয়ে জঘন্যতম এবং নৃশংস হত্যাকান্ড। স্বপরিবারে হত্যা করার হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালী। বাংলাদেশের স্থপতি। বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে। বিশ্বাসঘাতকদের সাথে হাত মিলিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর লাশ ফেলে সেই লাশের উপর দিয়ে আওয়ামীলীগ নামধারী কিছু সদস্য সে দিন খুনি মুস্তাকের মন্ত্রী সভায় যোগ দেয়। এদের কারনে দীর্ঘ ১৮ বছর আওয়ামীলীগ ছিলো ক্ষমতার বাইরে। সেই দূর্যোগকালে প্রকৃত বঙ্গবন্ধু প্রেমি সে সব নেতা কর্মীদের উপর নেমে আসে সরকারি অত্যাচার, নির্যাতনের স্টিমরোলার। সুবিধাবাদীরা দল ছেড়ে তখন পালিয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু মুজিব আদর্শের সৈনিক দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে দলের জান্ডা সমুন্নত রেখেছে। সুনামগঞ্জেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

সেই দূর্যোগ সময়ে ১৫ আগষ্ট ১৯৮৫ সালের শোক দিবস পালনের কথা মনে পড়ে। তখন দেশে এরশাদের স্বৈরশাসন চলছে। প্রথম বারের মতো সারা দেশ জোরে প্রকাশ্যে জাতীয় শোক দিবসের প্রস্তুতি চলছে। ঢাকা থেকে পোষ্টার এসেছে। নেতা কর্মীরা তেমন নেই। যারা আছেন তারা আবার কয়েক ভাগে বিভক্ত। ছাত্র নেতাদের অনেকে চাকুরী নিয়ে নিস্ক্রিয়। কেউ বিদেশে চলে গেছেন। এর মধ্যে আবার কয়েক খন্ডে বিভক্ত। কেউ মিজানলীগে, কেউ জাতীয় ছাত্রলীগে। কেউ আবার খন্ডিত আওয়ামীলীগের ভিন্ন গ্রুপে। মুজিবাদী ছাত্রলীগ বলতে আমরা কয়েকজন। এডভোকেট নুরুল ইসলামের বাসায় ডেকে নিয়ে আমাদেরকে পোষ্টার দেয়া হলো। কাউকে পাওয়া যায়না। বিভিন্ন অজুহাতে অনেকে সরে থাকেন। হাতে গুনা কয়েকজন ছাড়া রাস্তায় ‌রাজনীতির মাঠে কেউ নেই। আমরা কিছু কর্মী দুইদিন ধরে শহরের হোটেলের বর্ডারদের কাছ থেকে ও বাজারের কিছু পরিচিত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা সংগহ করলাম।

সার্বক্ষণিক সাথী আওয়ামীলীগ অফিসের সহকারী আবদুল বাছিত ও ষোলঘরের মরহুম আব্দুর রাজ্জাক । ইমানুজ্জামান মহী, মুক্তিযোদ্ধা শাহীন বাঙ্গালী, আমির হোসেন রেজা, অন্য আর কেকে ছিলেন মনে নেই।আমরা শুরু করলাম চাল, ডাল‌ সংগ্রহ। বাছিত বস্তাকাধে‌ ছুটে চলছে,। দু’দিনে বেশ ভালোই সংগ্রহ হলো। দূর্ভাগ্য আমাদের এখন বহু নেতা দেখা যায়। সে দূঃসময়ে অনেককে পাইনি।চোখে ও পড়েনি।

সে বছর সরকার প্রকাশ্যে জাতীয় শোক দিবস পালনের অনুমতি দিলেও পুলিশ পদেপদে বাধার সৃষ্টি করে। তাদের অত্যাচার ও বাধার কারনে কর্মসূচি পালনের কোন সুষ্ট পরিবেশ ছিলো না। কিংবা দাঁড়নোরও কোন উপায় ‌ছিলো না। ছায়ার মতো তারা আমাদেরকে অনুসরণ করত থাকে। একটা মনোস্তাত্ত্বিক চাপের মধ্যে আমরা সবাই।

‘কাঁদো বাঙালী কাঁদো’ পোস্টার শহরে দেয়ালে দেয়ালে সাটানো হলো। সারা রাত জেগে পুলিশি খবরদারির মধ্যে আমরা কষ্ট করে পোষ্টার লাগালাম। সকালে দেখি বেশীরভাগ পোষ্টার উদাও। পুলিশ প্রায় সব কটি পোষ্টার ছিড়ে ফেলেছে।

আজকের তাহিতি হোটেল যেখানে সেখানে ছিলো সৈয়দ সেলিম আহমদের সাইকেল, রিক্সার পার্সের দোকান। কিছু পোষ্টার রাখা ছিলো সেখানে। সাবেক মেয়র মরহুম জগলুল ভাইয়ের সমর্থক আবু তারেক ব্লাফ মেরে সব পোষ্টার নিয়ে যায়। জগলুল ভাই তখন আওয়ামীলীগের ভিন্ন গ্রুপ করতেন। মহীভাই দেখেন শহীদ মিনারে আয়ুব বখত জগলুলের সঙ্গী সাথীরা‌ তা সাঁটিয়ে দিচ্ছে। পোষ্টার আনতে গিয়ে শুরু হয় বাকবিতন্ডা। এক পর্যায়ে শুরুহয় হাতাহাতি। তুমুল বিতন্ডার মধ্যে বেশ কিছু পোষ্টার আমারা উদ্ধার করে নিয়ে আসি। সুবিধাবাদী নেতাদের এসময় দেখা যায়নি। মুজিবাবাদী নামদারী কিছু ছাএলীগে, যুবলীগ কর্মীদের তৎপরতা সে সময় লক্ষণীয়। এরাই ছিলো দলের প্রাণ। শহরে পরিচিত এই কয়েকজনের মুখই দেখা যেতো।

সেদিন দুপুর পোনে‌ দু’টার দিকে কাঙালিভোজের কর্মসূচিতে সুনামগঞ্জ থানার পূলিশ প্রথম বাঁধা দেয়। পাবলিক লাইব্রেরীর‌ সামনে খাদ্য বিতরণ চলছিলো। এ সময় প্রায় ১২/১৫জনের‌ একদল পুলিশ আমাদের উপস্থিতিতে কাঙালীভোজের (ঠেলা গাড়ি)সহ বড় ডেসকীভর্তি খিচুড়ি থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের সাথে এনিয়ে তুমুল ‌তর্ক হয়। পুলিশ মারমুখী হয়। অকথ্য ভাষায় ‌গালিগালাজ করে।

আমরা কিছু তরুন ছাড়া কেউ নেই। মহীভাই সাবেক এমপি মরহুম আব্দূজ জহুর সাহেকে খবর পাঠালেন। খবর পেয়ে তিনি আসেন সাথে এডভোকেট আফতাব উদ্দিন ও দিল‌ওয়ার হোসেন সাহেব ও। আমি, আমির হোসেন রেজা ,মহী ভাই, রজ্জাক ভাই, বুধুদা, বাছিত সাথে বিভিন্ন পেশার কিছু মানুষ নিয়ে তাৎক্ষণিক থানার সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করি। মরহুম আব্দুজ জহুর সাহেব,দিল‌ওয়ার‌ হোসেন, আমির হোসেন রেজা, মহীভাই, প্রমুখ ‌বক্তব্য রাখেন।

একসময় ‌অবস্হাবেগতিক দেখে পূলিশ‌ বাধ্যহয়ে কাঙালীভোজের সমস্হ জিনিষ ফেরৎ দেয়। নজীরবিহিন ঘটনার স্মৃতি এখন মনে উজ্জ্বল। সেদিন ইমানুজ্জামান মহী সহ অন্যদের সাহসী ভুমিকা আজ‌ও মনে পড়ে। এসব ত্যাগী, প্রতিবাদী জনদের কথা আজ অনেকের মনে নেই। সে দিনগুলোতে পুলিশ সময়ে অসময়ে আমার বাসায় হানা দিত। রাজনৈতিক কারনে মানসিক টর্চার করতো। সেদিনের দুর্দিনে সুনামগঞ্জ এর রাজনৈতিক ‌ময়দানে যারা সক্রিয় ছিলেন আজ তাদের মূল্যায়ন নেই।

এই প্রতিবেদনে সংযুক্ত ছবিগুলো ‌কালের সাক্ষী।

✓১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস। শোক দিবস শুধু শোক প্রকাশ নয়। শোককে যেনো আমরা শক্তিতে  পরিনত করতে পারি তাই যেনো হয় অঙ্গিকার। তে পারি তাই যেনো হয় অঙ্গিকার।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn