ফয়সল আহমদ রুহেল :

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বজলুর রহমান। ভালো মানুষ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে শিক্ষকতা জীবন শুরু। তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে নৈতিকতা বা মূল্যবোধ অনুশীলনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। যার ফলে সকল কর্মকান্ডে ফুটে উঠে ভালো মানুষ গড়ার প্রত্যয়। ভবিষ্যতে ভালো মানুষ হওয়ার জ্ঞান প্রদান করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করেন। দীর্ঘ ৩৮ বছর শিক্ষকতা জীবনে তাঁর অসংখ্য শিক্ষার্থীরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত। তিনি সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার বাদশাগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।

জন্ম :

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বজলুর রহমান ১৯৫৭ ইং সনের ২৭ জানুয়ারি নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান গ্রামের মামার বাড়ি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার রানিগাঁও গ্রামে। পিতা ওয়াফিজ উদ্দিন আহম্মদ ও মাতা উম্মে কুলসুম। পিতার পেশা ছিল কৃষি। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ ভাই। অন্য দুই ভাইয়ের একজন শিক্ষকতা করেন,অন্যজন পারিবারিক জমিজমা দেখাশোনা করেন। বর্তমান তিনি নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা বৃ-কালিকা এলাকায় বসবাস করছেন।

পারিবারিক :

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বজলুর রহমান ব্যক্তিগত পারিবারিক ও কর্মজীবনে সহধর্মিনী জেসমিন সুলতানার অতুলনীয় সহযোগিতা পান। বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক।ছেলে ডা. রিফাত রহমান এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), সহকারী রেজিষ্ট্রার, মেডিসিন বিভাগ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ এবং মেয়ে ডা. ফারিহা সুলতানা এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), মেডিকেল অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বারহাট্টা, নেত্রকোনা তে কর্মরত। পুত্রবধু ডা. সামিয়া তাসনিম- এফ,সি,পি,এস, ট্রেনিংরত, শিশু বিভাগ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জামাতা মো. মাহফুজুল আযম ঘোরী-এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) এস,কে,এফ গ্রুপ এ কর্মরত আছেন। মেয়ের দিকের একমাত্র নাতি মো. ফাতিন ইশারাক ঘোরী।

শিক্ষা জীবন :

তিনি ১৯৬২ ইং সনে নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার বাহাদুরপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এরপর ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ ইং সনে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৬৭ ইং সনে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান সিটি হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এরপর ১৯৬৮ ইং সনে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার মোহনগঞ্জ সরকারী পাইলট হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ ইং সনে ঢাকার বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৪ ইং সনে ঢাকা বোর্ডের অধীনে নেত্রকোনা সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। ১৯৭৬ ইং সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একই কলেজ থেকে বিএসসি (স্নাতক) পরীক্ষায় ২য় বিভাগ পান। তিনি ১৯৮২ ইং সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড পরীক্ষায় ১ম শ্রেণী লাভ করেন। একই সময় বাগ্মি তার্কিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৯৭ ইং সনে অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

শিক্ষকতা জীবন :

তিনি সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার বাদশাগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে ১৯৭৮ ইং সনের ৫ অক্টোবর থেকে ১৯৮৪ ইং সনের ২৯ মে পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। এরপর নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৯৮৪ ইং সনের ৩০ মে থেকে ২০১০ ইং সনের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

সর্বশেষ সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার বাদশাগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে ২০১০ ইং সনের ১০ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ ইং সনের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে চলে যান। এছাড়াও তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক পরীক্ষার রসায়নের প্রধান পরীক্ষক হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন।

শৈশব :

গুণী শিক্ষক বজলুর রহমান শিক্ষাজীবনে বাবা-মা ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মন্ডলী ও আত্মীয়স্বজন তন্মধ্যে তাঁর ছোট মামা মরহুম আসিদ উদ্দিন খান ও দুই ফুফাতো ভাই মরহুম মজিবুর রহমান শেখ এবং মরহুম নুরুল ইসলাম শেখ এর নিকট হতে অপরিসীম উপকৃত হয়েছেন। এছাড়া যার নিকট থেকে বেশি উপকৃত হয়েছেন তিনি হচ্ছেন মরহুম শামছুল হক সাহেব। মোহনগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। তাদের বাসায় থেকে ৭ম শ্রেণী হতে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন বজলুর রহমান। অসাধারণ গুণাবলী এই মহান ব্যক্তি সংস্পর্শে থেকে মানবিকতা, ব্যক্তিত্ব, সততা ও কর্তব্যনিষ্টা সমন্ধে জ্ঞান অর্জন করেন। যা পরবর্তীতে বাস্তবজীবনে এই শিক্ষকের জীবনে প্রতিফলন ঘটে।

বিদ্যালয়ের জন্য যতকিছু :

গুণী শিক্ষক বজলুর রহমান শিক্ষকতা জীবনে বাদশাগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক বাবু ভূপেন্দ্র পাল বড়ুয়া স্যারের নিকট হতে সুশিক্ষিক হওয়ার পরামর্শ পেয়েছেন। যার ফলে কর্মজীবনেও উপকৃত হন। বাদশাগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আন্তরিকতার সাথে কর্তব্য সম্পাদন করার চেষ্টা করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বল্পতা দূর করার লক্ষ্যে ৬টি শাখা শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ফলে ৬ জন নতুন শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এতে এমপিওভূক্ত শিক্ষক সংখ্যা হয় ১৮ জন। যার ফলে পাঠদান কার্যক্রম সহজ হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সাল হতে বিদ্যালয়টি সরকারীকরণ কার্যক্রম শুরু হয়। যার ফলস্বরূপ বিদ্যালয়টি এখন একটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়। আবার ২০১৬ সালে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতায় বিদ্যালয়টিতে এস,এস,সি পরীক্ষার কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এ সকল কার্যক্রমে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির তখনকার সভাপতি মাননীয় সংসদ সদস্য, সুনামগঞ্জ-১ জনাব ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

কৃতিত্ব :

তিনি ১৯৮৫ সালে বারহাট্টা উপজেলার শ্রেষ্ঠ শ্রেণী শিক্ষক ও ২০১৫ নালে ধর্মপাশা উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন।

হৃদয় বিদারক ঘটনা :

৮ জুন ২০১০ খ্রি. বাদশাগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে আসার পথে বিদ্যালয়ের ৩ জন ও পার্শ্ববর্তী বালিকা বিদ্যালয়ের ৫ জন ছাত্রীর নৌকা ডুবিতে হাওরে সলিল সমাধি ঘটে। এ হৃদয় বিদারক ঘটনা আজও পীড়া দেয় তাঁকে ।

২০২৩ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ধর্মপাশা উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ২৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ ( রুহেল )।

উল্লেখ্য, ২২ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।

তিনি শিক্ষকতা জীবনে অসংখ্য গুণগ্রাহী শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্য পেয়েছেন। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন কারণ সকলের সহযোগিতায় নিষ্টার সাথে কর্মজীবন সম্পন্ন করতে পারায়। তিনি শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমেই নয়, বাস্তবমুখী ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে একজন সুশৃঙ্খল, পরিশ্রমী, সৎ ও সাহসী মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার শিক্ষাটা প্রদান করেন অবসরে যাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত।গুনী এই শিক্ষক কাগজে কলমে অবসর নিলেও, এখনো তিনি শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। সময় সুযোগ পেলে আরো বড় পরিসরে তিনি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েই আজীবন কাজ করে যেতে চান।এই স্বপ্ন জাগানো মানুষটির সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি।

Like
Comment
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn