জেলার কুলাউড়ার রাজনীতিতে এখন নেতৃত্ব সংকট চরমে পৌঁছেছে। এক এগারো ও তৎপরবর্তী সংস্কারপন্থী ঝড় এবং জাতীয় রাজনীতিতে উপেক্ষিত থাকায় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে কুলাউড়ার রাজনীতি। একসময় কুলাউড়ার রাজনীতিতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদানকারী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, নওয়াব আলী আব্বাছ খান, এম এম শাহীন বর্তমান দলীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে এখন অনেকটাই নিষ্প্রভ। বিভিন্ন মহলের দাবি, এক/এগারোর পটভূমিতে সংস্কারপন্থী ঝড়ে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ক্ষতি হয়েছে কুলাউড়ার। সংস্কারপন্থী হিসেবে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, এম এম শাহীন দলীয় রাজনীতি থেকে ছিটকে গেছেন এবং নওয়াব আলী আব্বাছ খান জাতীয় পার্টির কাজী জাফর গ্রুপে যোগ দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে দলীয় রাজনীতিতে নির্বাসিত রয়েছেন। জাতীয় রাজনীতিতে কুলাউড়ার রাজনীতি উপেক্ষিত থাকায় আ’লীগ, বিএনপি বিভিন্ন সময় মৌলভীবাজার-২ আসনে (কুলাউড়া-কমলগঞ্জ আংশিক) তৃণমূল নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় জনগণের কাছে অনেকটাই অপরিচিত এবং জনসম্পৃক্ত না থাকা ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে প্রার্থী করায় এই নেতৃত্ব সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে।

নেতৃত্বের অভাবে স্থানীয় আ.লীগ ও বিএনপিতে দলীয় কোন্দলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। নিজেদের ভুল সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক ট্রেন মিস করেছেন তাঁরা। তাছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে দলীয় কোন প্রভাবশালী নেতাকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন না দেওয়ায় সাবেক উপজেলা আ’লীগের সভাপতি ও বর্তমান সাংসদ আব্দুল মতিন দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হলেও জনসম্পৃক্ত নন তিনি। এই এলাকার কোন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ বর্তমানে সংসদে সংসদ সদস্য না থাকায় এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও অনেকটাই ভাটা পড়েছে।

সাবেক ডাকসু’র ভিপি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-২ আসনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হন। তার নেতৃত্বে এ অঞ্চলে স্থানীয় আ’লীগের দলীয় কর্মকাণ্ড ও এলাকার উন্নয়ন বেশ পরিলক্ষিত ছিল। পরবর্তীতে ২০০১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এম শাহীনের কাছে পরাজিত হলেও স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বেশ সরব ছিলেন তিনি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহতও হন তিনি। এক/এগারোর মাইনাস টু ফর্মুলার পটভূমিতে দেশের বেশ কয়েকজন দাপুটে রাজনৈতিক নেতার সাথে সুলতান মনসুর সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতি পান। এরপর দল থেকে অনেকটাই ছিটকে পড়েন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তোফায়েল আহমদ, সুরঞ্জিত সেনরা দলীয় মনোনয়ন পেলেও সুলতান মনসুর দলীয় মনোনয়ন পাননি। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় সে সময় নির্বাচনে অংশ না নিলেও অনেকটাই প্রকাশ্যে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নওয়াব আলী আব্বাছকে সমর্থন দেন। সেই নির্বাচনে নওয়াব আলী আব্বাছের জয়ী হওয়ার পেছনে তার অবদান ছিলো লক্ষণীয়।

এক/এগারোর কুশীলব হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের অন্য নেতৃবৃন্দরা দলে ঠাঁই পেলেও কেন্দ্রীয় পদ হারানোর পাশাপাশি দল থেকে পুরোপুরি ছিটকে পড়েন তিনি। এরপর থেকে দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় না থাকলেও অনেক সময় দল এবং সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নানা আলোচনার জন্ম দেন তিনি। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী জানান, দলীয় রাজনীতি থেকে ছিটকে যাওয়ার পর কুলাউড়ার তৃণমূল আওয়ামী লীগে কোন প্রভাব নেই তার। তিনি যখন দলীয় পদে ছিলেন, তখন কুলাউড়া আওয়ামী লীগে দলীয় কোন্দল থাকলেও তা প্রকাশ্য ছিলো না। বর্তমানে দলীয় কোন্দল প্রকাশ্য। বর্তমানে তিনি অনেকটাই রাজনৈতিক নির্বাসনে।

দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে জেলা জুড়ে আলোচিত আরেক নেতা জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি এম এম শাহীন। নব্বই দশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে স্থানীয় বিএনপিকে বেশ সুসংগঠিত করেছিলেন তিনি। ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের গ্যাড়াকলে পড়ে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রভাবশালী নেতা সুলতান মোহম্মদ মনসুরকে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন। কিন্তু সে সময় দলীয় সিদ্ধান্ত না মানায় দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। তাছাড়া এমপি থাকাকালীন অবস্থায় তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের পুত্র ও মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি তৎকালীন এমপি নাসের রহমানের সাথে রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন।

পরবর্তীতে ২০০৬ সালে কুলাউড়ায় একটি জনসভায় তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাকে আবারও দলে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দিলেও এক/এগারো’র সময় সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার সাথে তিনিও সংস্কারপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হন। ওই সময় নতুন গঠিত ফেরদৌস কোরেশীর পিডিবির অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতাসহ তিনিও সেখানে উপস্থিত হয়ে সেই দলে যোগদানের বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন।

সংস্কারপন্থী হিসেবে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন তিনি। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আবারও তিনি এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নওয়াব আলী আব্বাছের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন। এরপর থেকেই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় তিনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিলেও ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে নিজ নেতাকর্মীদের নিয়ে কুলাউড়ায় কালো পতাকা মিছিল দিয়ে আবারও ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেন এম এম শাহীন। ওই মিছিলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ ও ধরপাকড় চালায়। এ ঘটনায় তিনিসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী মামলার আসামি হয়ে জেল খাটেন। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে অংশ নেন তিনি। জয়ী হতে না পারলেও তার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল এবং ব্যাপক আলোচনায় চলে এসেছিলেন। বর্তমানে সপরিবারে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।

মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে তিনবারের নির্বাচিত সাবেক এমপি নওয়াব আলী আব্বাছ খান বর্তমানে অনেকটাই রাজনীতির অন্তরালে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন তিনি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়াকে কেন্দ্র করে আবারও বিভক্ত হয়ে পড়ে জাতীয় পার্টি। ২০১৩ সালে নওয়াব আলী আব্বাছ খানসহ দলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে সরে গিয়ে কাজী জাফরের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। জাতীয় পার্টির (জাফর গ্রুপে) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদ পান তিনি। জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলেও জাতীয় পার্টি (জাফর) নির্বাচন বয়কট করায় নওয়াব আলী আব্বাছ নির্বাচনে অংশ নেননি। জাতীয় পার্টির (জাফর গ্রুপে) চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ ২০১৫ সালের আগস্টে মারা যাওয়ার পর থেকে দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে তিনিও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিশ্চুপ রয়েছেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn