চুননু জামান-

অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করছিলেন যে অসাধারণ মানুষটি তার সম্বন্ধে লিখতে বসে প্রথমেই ভাবনায় পড়েছি।  সেই অসাধারণ মানুষটির কোন দিকটি নিয়ে লিখব, রাজনৈতিক নেতা, ভাষা সৈনিক, বিপ্লবী, সুগভীর পাণ্ডিত্যে ভরা শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যতিক্রমধর্মী লেখক বা কোন্ আব্দুল হাই এর কথা লিখব?  হা তিনি ছিলেন আমাদের গোলাপ মামা। সাম্য শশ্রুমন্ডিত গুরু গম্ভীর চেহেরা, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এবং চলা ফেরার মধ্যে একটা আভিজাত্যের ছাপ ছিলো স্পষ্ট। তিনি ছিলেন আমার বড় চাচীর আপন ছোট ভাই। বড় চাচী মানে প্রয়াত এডভোকেটশামসুজ্জামান সুফি ভাইয়ের মেঝ মামা। বড় চাচা আর আমাদের এক সময় একান্নভূক্তি পরিবারে বসবাস ছিলো। আমার জন্ম ষোলঘরের চাচার বাসায়। বড় চাচী আদর করে আমার নাম চুননু রেখেছিলেন।

একটি দুঃখের কাহিনী এ মূহুতে খুব মনে পড়ছে। বিষয়টি হয়তো অনেকেরই অজানা। আব্দুল হাই সাহেবের এক ছোট ভাই ছিলেন আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী লাট মিয়া। অকাল প্রয়াত আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী লাট মামা ষোলঘরে সুফি ভাইদের বাসায় থেকে কলেজে পড়তেন। ১৯৫২ সালে তিনি আই এ পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। মাত্র ৪ পেপার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। উনি নাকি খুবই চৌকস ছিলেন। চলনে বলনে চেহেরায় এবং স্বাস্থ্যে। তিনিও মেধাবী ছিলেন এবং ছাত্র রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। হাই সাহেব ও লাট মিয়া দুই ভাই যখন ছাত্র সভায় পুরাতন কলেজের সামনে বক্তৃতা করতেন তখন নাকি মানুষ মন্ত্র মুগ্ধের মতো-শুনতো।

মা চাচীর কাছে শুনা -চাচাদের বাসায় ছিলো বেল গাছ। সেদিন ছিলো পূজা। উনার এক হিন্দু বন্ধু পুজার জন্য তার বেল গাছের বেলপাতা চেয়েছিলেন। তখন প্রচলিত একটা কুসংস্কার বা ধারণা ছিলো বেল গাছে অশারীরিক কিছু থাকে। চাচী অর্থাৎ উনার বোনের কাছে বললে তিনি সমূহ আপদ বিপদ ঘটতে পারে ভেবে লাট মামাকে গাছে উঠে বেলপাতা পারতে নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি কাউকে না জানিয়ে পুজার রাতে বেলপাতা পারার জন্য গাছে উঠেন। বেলপাতা পেড়ে নামার সময় পায়ের মধ্যে কি যেনো একটা খুচার মতো অনুভব করেন। তারপর উনার প্রচন্ড জ্বর। এক রাতের পরের দিনই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তাকে দাফন করার পর পরই বাসায় পুলিশ তাকে ধরার জন্য ওয়ারেন্ট নিয়ে হাজির হয়।

ভাষা আন্দোলনের জন্য পাক শাসক গোষ্ঠি হাই সাহেবকে দু’দিন পূর্বে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। তিনি জেল থেকে তার ছোট ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মুষড়ে পড়েন। ছোট ভাইয়ের অকাল মৃত্যু গোলাপ মামাকে খুবই ব্যথিত করেছিলো। কারন একই রাজনৈতিক আদর্শে ও ভাব ধারায় তার ছোট ভাই ছিলেন তার সহযোগী। উনার এই ঘটনার পর আর কোন দিন তাদের পরিবার বেল-খাওয়া-হয়নি। ঐ সময় সুনামগন্জে হিন্দু মুসলমানের বন্ধন, সৌহার্দ সম্প্রীতি ছিলো সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। লাট মামা জীবন দিয়েও তাই রক্ষা করে গেছেন।

গোলাপ মামাকে অতি নিকট থেকে দেখেছি। আমরা আত্নীয়তার সূত্রে আবদ্ধ হলেও কেনো যেনো একটা ভয় এবং সংকোচ কাজ করতো। শুধু আমার না বিষয়টি সব আত্নীয় পরিজনের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। শুনেছি ভাগ্নারা নাকি উত্তরাধিকারী সূত্রে স্বভাব চরিত্র অনেকটা মামা বাড়ি থেকে পেয়ে থাকেন। তাই উনার বড় ভাগ্না শামসুজ্জামান সুফি ভাইয়ের স্বভাব চরিত্রে অনেকটা মিল ছিলো। তার লেখনী ও রাজনীতির মধ্যে কোনো ফারাক বা দ্বন্দ্ব ছিল না। তিনি লিখেছেন শোষিত বঞ্চিত গরিবের জন্য। তার ক্ষুরধার লেখনীতে তাই প্রকাশ পেয়েছে। আজীবন তিনি সাফল্যের তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। আমাদের সমাজ আমাদের সোসাইটি তাঁকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেনি।

আব্দুল হাই ছিলেন শিক্ষক। শিক্ষকরাই মানুষ গড়ার কারিগর। পৃথিবীতে সবচেয়ে সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ পেশা হলো শিক্ষকতা। একজন শিক্ষক অবশ্যই অনুকরণীয়, আদর্শিক জ্ঞানের অধিকারী, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন, শালীন, মার্জিত হবেন। জনাব হাই সাহেব ছিলেন সে সব গুণাবলীর অধিকারী। উত্তম আদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলা, কথা ও কাজে মিল রাখা, আদর্শ প্রচারে কৌশলী ও সাহসী হওয়া, শিক্ষকতাকে পেশা ও নেশা হিসেবে লালন করা, বিশুদ্ধ উচ্চারণ, প্রকাশভঙ্গি ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, ছাত্রদের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসা সম্পন্ন হওয়া, নিয়মিত জ্ঞানচর্চা করা, মেধা বিকাশে সহায়ক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়া, স্নেহ-মমতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো, সকল শিক্ষার্থীকে সমান চোখে রাখা, শিক্ষার্থীদের জ্ঞান লাভে উৎসাহিত করা, বরং দরদী মন নিয়ে তাদের ভুলগুলো শুধরে দেবার চেষ্ঠা করা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলি জনাব হাই সাহেবের জীবনে সমাহার ঘটেছিলো।

তিনি ছিলেন বিচক্ষণ, ছাত্রদের মন-মেজাজ পছন্দ-অপছন্দ ও কোনো কিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে তার দৃষ্টি ছিলো। তিনি মানসিক ভারসাম্য বজায় রেখে, নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে অটল থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অভিভাবকের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা করেছেন।  কর্মক্ষেত্রের সর্বত্রই তাঁর সাফল্য ছিলো, তাঁকে নিয়ে বিতর্ক ওঠেনি কখনও; সমালোচনাও না। অমায়িক ছিলেন ব্যবহারে, সদাহাস্য, সব শ্রেণীর মানুষের সাথেই মিশতেন আন্তরিক ভাবে। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের বাইরেও তাঁর ছিলো বিরাট সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডল, গ্রহণযোগ্যতাও ছিলো সর্বস্তরেই।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে তিনি যুক্তফ্রন্টে যোগদান করেন। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। ঐ সময় তিনি শেরে বাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, মৌলানা ভাসানী ও বংঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য জাতীয় নেতাগণের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পান। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু ঐ সময়ে দেশে দুর্ভিক্ষ চলছিল। সুনামগঞ্জ মহকুমা রিলিফ কমিটি গঠন করে ষোলঘর নদীর পাড়স্থ গৌরি পুরের কাচারীর ম্যানেজার অফিসে লংগরখানা চালু করে দুস্থ মানুষের  জন্য খাদ্য বিতরণের কাজ চলছিল। তিনিও এসে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ঐ সময় এর সম্পাদক ছিলেন কমরেড বরুণ রায়। পরবর্তীতে বরুণ রায় গ্রেফতার হলে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে নিষ্ঠার সাথে দুস্থ মানুষের সেবায় দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি সমস্ত মনপ্রাণ, সমগ্র জীবন দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন জননী, জন্মভূমির নীল আকাশ, শীতল বাতাস, সবুজ বনানী, হাওর বেষ্ঠিত সুনামগঞ্জের শ্যামল প্রান্তর আর শান্ত স্নিগ্ধ নদী সুরমাকে। ঠিক তেমনি ভালোবেসে ছিলেন সুনামগঞ্জের সুন্দর প্রকৃতির লীলা নিকেতনের বসবাসকারী শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, ভাগ্যহত মেহনতি মানুষদের। তিনি সারা জীবন চেয়েছিলেন তাদের শোষণমুক্ত করে মানবেতর স্তর থেকে সর্বাঙ্গে সুন্দর উন্নত মানুষের স্তরে টেনে তুলতে। তাইতো সুনামগঞ্জের মাটি ও মানুষের টানে তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে আসেন। আর ঢাকাতে ফিরে যাননি। এখানেই তার জীবনের একটা বড় টানেল। যার জন্য তিনি জাতীয় নেতা হতে পারেননি। সুনামগঞ্জের দুর্ভাগ্য তারা সুযোগ্য নেতৃত্ব ও একজন যোগ্য জাতীয় নেতা থেকে বঞ্চিত হলো। তিনি ছিলেন উঁচু মানের সাহিত্যিক। তাঁর ’উত্তাল তরঙ্গে’ ও ‘উতলা বাতাসে’ নামক দুটি কাব্যগ্রন্থ এবং গনি সংগীত’ ও ভাইবে রাধা রমন বলে’ নামে দুটি গানের সংকলন প্রকাশিত হয়েছিলো। তাছাড়া ‘নকীব’ ছদ্ম নামে তার বহু লেখা রয়েছে।

জনাব আব্দুল হাই সাহেবের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে ৫৬-৫৭ সাল থেকেই সুনামগঞ্জ জুবিলী স্কুলের মাঠে হাছন মেলার আয়োজন করা হতো। সেখানে পীর মোর্শিদী গান হতো বলে যাকে ফকির মেলা হিসাবেও অভিহিত করা হতো। পরবর্তীতে  হাছন উৎসব হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। তখন ঐ উৎসবে সভাপতিত্ব করতেন দেওয়ান আনোয়ার রাজা চৌধুরী এবং সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন জনাব মোহাম্মদ আব্দুল হাই।

জনাব মোহাম্মদ আব্দুল হাই ১৯৫৭ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের বছর খানেক পর তার কোল জুড়ে আসে এক ফুটফুটে ছেলে। তার নাম রাখা হয় মৃদুল। কিন্তু ৩/৪ মাস বয়সেই মৃদুল হঠাৎ মৃত্যু বরণ করে। হাই সাহেব তখন পুত্র হারানোর ব্যথায় একেবারে ভেংগে পড়েন। তাদের একান্নভূক্ত পরিবার ছিলো। খাওয়া দাওয়া সব এক সাথেই চলতো। তখন উনার বড় ভাই জনাব আব্দুল আহাদ চৌধুরীর তিন ছেলে। শোক লাঘব করার জন্য ঐ সময়ে তার বড় ভাইয়ের ছোট ছেলে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মারুফ ভাইকে দত্তকের মতো তার ঘরে নিয়ে আসেন। মারুফ ভাইকে তিনি আদর করে ‘কুঞ্জ’ বলে ডাকতেন। ছেলে হারানোর দু:খকে ভুলে এভাবেই কুঞ্জকে নিয়ে চলছিলো তার জীবন। কিন্তু তিন/চার মাস পর তার পিতা মাতা মারুফ ভাইকে তাদের কাছে পুনরায় নিয়ে এলে হাই সাহেব ভীষন ব্যথা পান। তারপর সাত থেকে আট মাস তিনি বাড়ির কারো সাথে কথা বলেননি। এমনকি বাড়িতে একসাথে খাওয়া দাওয়া ও বন্ধ করে দেন।

সাইকেল চালানোর তিক্ততার মধুর অভিজ্ঞতার স্মৃতি আমাকে বিমোহিত করে বেড়ায় এখনো। মনে পড়লেই কেমন যেন একটা ধাক্কানো ভাবের সৃষ্টি হয়। হৃদয়কে উদ্বেলিত করে চমকে দিয়ে যায় স্মৃতির অবগাহনকে এখনও। আমাদের হারিয়ে যাওয়া দিনের স্মৃতিমাখা ছোট ছোট বেদনা কিংবা মধুময় ছোট ছোট সুর সবই যেন কেমন একটা গন্ধ মুখর আমেজের সৃষ্টি করে, যা এখনো মনে হলেই স্মৃতির আর্কাইভ হাঁতড়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। সাইকেল ছিলো আব্দুল হাই সাহেবের নিত্য সংগী। জীবনের শেষ সময়েও তাঁর সংগী ছিলো সেই সাইকেল। তার সাইকেল সবাই চিনতো। একদিনের এক ঘটনা-হাই সাহেব তাঁর সাইকেল কোথায় জানি রেখে বাড়িতে চেলে এসেছেন। অনেক রাতে গারদের পুলিশ বাড়িতে সাইকেলটি দিয়ে যায়। তাছাড়া হাই সাহেবের বড় ভাই আব্দুল আহাদ চৌধুরী তারা মিয়া সাহেবেরও সাইকেল ছিলো একান্ত সাথী। সেই আমলে হাই সাহেবের নামী সাইকেল ছিল হারকিউলেস এবং তারা মামার ছিলো রেলি সাইকেল।

আমাদের ছোট্র শহরে আরো যে ক’জন মান্য ব্যক্তি নিয়মিত সাইকেল চালাতেন তারা হলেন শ্রদ্ধেয় আবু হানিফা নওয়াব মিয়া সাহেব, বিহারী ডাক্তার সাহেব ,ডাক্তার আবুল লেইস ময়না মিয়া সাহেব, রাহাত মন্জিল বা আতুয়াজান গেষ্ট হাউসের মালিক গণি দারোগা সাহেব, মেজর ইকবাল ভাইয়ের পিতা আবুল হোসেন মোক্তার সাহেব প্রমূখ উল্লেখযোগ্য। ছোট ছোট অনেক স্মৃতি এ মূহুর্তে চোখের সামনে ভীড় করছে। তৎকালীন সময়ে রমজান মাসে বিহারী ডাক্তার সাহেব সুনামগঞ্জ শহরের অলি গলিতে সাইকেলে করে ব্যাকুল বাঁশী বাজিয়ে মুসল্লিগণকে সেহেরীতে উঠার জন্য ঘুম থেকে জাগাতেন। সাইকেলের চাকা লিক করত, ‘বার্স্ট’ করত। সুনামগন্জে মধ্য বাজারে ছিলো যুগেন্দ্র মেকার। সবাই বলতো যুগেন্ড। উনার স্টোরে খেলার সরঞ্জাম সহ অনেক কিছুই ছিলো। তাই তার কাছে যেতো হতো। তিনি লাল রঙের টিউবে ঝামা ঘষে লাল রঙের রাবার মধ্যে সলিউশনস দিয়ে পট্টি লাগায়ে বাইক টিক করে দিতেন।

শিক্ষক, রাজনীতীবিদ ও সমাজ সেবক হিসাবে তার জ্ঞানের জ্যোতির দ্বারা দেশ দেশের মানুষকে আলোকিত হতে ও সমাজকে জ্যোর্তিময় করতে সহায়তা করার চেষ্টা করেছেন। আব্দুল হাই সাহেব সাহিত্য জীবনের প্রথম যুগে তাঁর অন্তরের দেশাত্মবোধ ছিলো প্রধানতম প্রেরণা। রাজনৈতিক পরাধীনতা ও অর্থনৈতিক পরবশতা থেকে তিনি দেশ ও জাতির সর্বাঙ্গীণ মুক্তি চেয়েছিলেন। তিনি তার গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, সাংবাদিকতা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার এবং শোষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠে তিনি ছিলেন সক্রিয়।

তিনি হাছন রাজার দর্শন সুফীবাদ ও রাধাঁ রমনের ভাব সঙ্গীতের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর ’উত্তাল তরঙ্গে’ ও ‘উতলা বাতাসে’ নামক দুটি কাব্যগ্রন্থ এবং গনি সংগীত’ ও ভাইবে রাধা রমন বলে’ নামে দুটি গানের সংকলন প্রকাশিত হয়েছিলো। আর তার লেখার শক্তি ও জীবনী শক্তির ভেতরে লুকানো ছিল এক গভীর দর্শন। জীবন ও জগতকে আলাদা করে দেখার এক স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি। তাইতো তিনি হাছন রাজার গান গবেষণা করতে করতে এক সময় তিনিই কিনা ‘হাছন পছন্দ’ নামে নিজকে অভিহিত করেন। সাধারণভাবে মরমী বলতে বোঝানো হয় বিশ্ব প্রকৃতির মর্মে যিনি প্রবিষ্ট। তিনিই মরমী। তবে আভিধানিক ভাবে দেখেতে গেলে দেখা যায় ইংরেজী Mystic শব্দের বাংলা অনুবাদ ‘মরমী’। তবে তিনি কি সে পথেই দাবীত হচ্ছিলেন! প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার মানুষ ধীরে ধীরে উদাস মানুষ হয়ে পড়েছিলেন।

১৯৮২ সালে তার একমাত্র পুত্র গালিবের অকাল মৃতু্তে তিনি একেবারে ভেংগে পড়েন। প্রিয় ছেলের অকাল মৃত্যু’র ব্যাথাই হাই সাহেবকে সমাজ ও সংসারের প্রতি বৈরাগ্য ভাবের দিকে নিয়ে যায়। তিনি ভেতরে ভেতরে রাতারাতিই বদলে যেতে থাকেন। তার মৃতু্র এর ঠিক পরবর্তী পর্যায়ে তিনি দু:খ ব্যথা কিছুটা প্রশমিত করতে ভারতের কলকাতা ,দিল্লী, আগ্রা ও আজমীর শরীফ বেড়াতে যান। ফেরার সময় তিনি অবলম্ভন হিসাবে একটি হাতের লাঠি নিয়ে আসেন। লাঠিটির     হ্যান্ডেলটি ছিলো রৌপ মোড়ানো কালো রংগের।

তিনি বুক ভরা কথা নিয়ে বাঁক রুদ্ধ জীবন এবং চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে নিশাচর চোখে ছিলেন স্থির নির্বাক। খুব দ্রুত ভেতরে ভেতরে তিনি পাল্টে যাচ্ছিলেন। তিনি যেনো নিজের অন্তরেই ঈশ্বরের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। কোন অনুযোগ কোন অভিযোগ ছিলনা তার। তবে স্থির দু,চক্ষুর দৃষ্টি দিয়ে তিনি কি কিছু বলতে চেয়েছিলেন, কি বুঝাতে চেয়েছিলেন, কিংবা কি মেসেজ রেখে গেছেন আমাদের প্রতি দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি সুশীল সমাজের প্রতি! আমরা কেউ বুঝতে পারিনি, কেউ মূল্যায়ন করতে পারিনি। এখানেই আমাদের  ব্যর্থতা।

মমত্ববোধ, মৈত্রী ও সমঝোতার অন্বেষণে তার প্রয়াস ছিল অক্লান্ত। সাংঘর্ষিক ও সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল দৃঢ়, নম্র ও শান্ত ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে সাধারণ মানুষের রাজনীতিতে আমৃত্যু সম্পৃক্ত ছিলেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, তবুও তিনি আমাদের অন্তরে চির জাগ্রত। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তার স্মৃতি, অর্থপূর্ণ জীবন ও লালিত মূল্যবোধ।

লেখক পরিচিতিঃ-চুননু জামান। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ।সাবেক ব্যাংকার সাহিত্যিক ও সমাজ সেবক।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn