ছয় বছর ধরে চলা সিরিয়া গৃহযুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ শিশু এতিম হয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। এসব এতিম শিশু বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, মানবপাচার চক্রের হাতে পড়ে অন্ধকার ভবিষ্যতের গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং তাদের অনেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ফাঁদে পড়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। সিরিয়ার ভেতরে ও বিদেশে এতিম শিশুদের জন্য যেসব আশ্রয়কেন্দ্র বা এতিমখানা গড়ে উঠেছে, সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। নানা সংকটের মুখে এতিমখানাগুলো শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে। সিরিয়ার হোমসে একটি এতিমখানায় আশ্রয় নেওয়া সিরীয় শিশু মারিয়া আল-সালান বলেছে, ‘যখন আমার বয়স পাঁচ, তখন সাবিয়াহ (একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী) হামলা চালায় এবং সবাইকে ঘিরে ফেলে… তারা সবার ওপর গুলি চালায় এবং সবাইকে হত্যা করে। তখন আমাদের মা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান এবং গুলিবিদ্ধ হন।’ ‘মা আমার কাছে পানি চেয়েছিলেন। যতক্ষণে আমি পানি নিয়ে ফিরে এলাম, ততক্ষণে তিনি আর নেই। আমি আর আমার ভাই রক্ত ও মরদেহের নিচে দুই দিন কাটিয়েছিলাম।’

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিপক্ষে যুদ্ধরত বিদ্রোহী বাহিনীর দখলে থাকা ইদলিবের একটি এতিমখানার প্রায় প্রত্যেকে মনোদৈহিক বিকলতা অথবা মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে। যুদ্ধের জন্য কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা। এতিমদের পরিচর্যাকারীদের জন্য তেমন কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। তাদের বেতন দরকার। শীত আসছে। শিশুদের রক্ষার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ভবন সংস্কার করা প্রয়োজন। কিন্তু কোথা থেকে এসবের জোগান হবে, তার কোনো হদিস নেই। সিরিয়া গৃহযুদ্ধে বাবা-মায়ের একজনকে অথবা উভয়কে হারিয়েছে, এমন কয়েকজন এতিমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের করুণ পরিস্থিতি সম্পর্কে। তাদের কথায় উঠে এসেছে নিজ দেশে শরণার্থী হয়ে বসবাসের হৃদয়বিদারক গল্প।

ওদায় ফায়াদ
‘আমরা আমাদের বাড়িতে বসে ছিলাম, তখন একটি বিমান আমাদের ওপর হামলা চালালো এবং ওই হামলায় আমাদের বাবা মারা গেলেন। যখন আমরা পাশের আল-ফারদোস এলাকায় চলে গেলাম, তখন আরেক বিমান হামলার শিকার হলাম এবং তাতে আমাদের ছোট্ট বোনটি মারা গেল। এরপর আমরা পাশের জিবদিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। আমরা একটি ভবনের বেসমেন্টে ছিলাম। সেখানে রকেট হামলা হলো এবং আমরা আমাদের মাকে হারালাম। তার দাফনও করতে পারেনি আমরা। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে ছিল আমাদের মৃত মা, আর আমরা চলে আসি এই আশ্রয়কেন্দ্রে।’

লানা ফায়াদ
‘এক বিমান হামলায় আমাদের বাবা নিহত হলেন। এরপর আরো বিমান উড়ে এল, হামলা চালালো। তাতে আমার মা, ছোট্ট বোন ও এক বোনের স্বামী মারা গেলন। বাড়ি ছেড়ে আমরা বেরিয়ে এলাম এবং বাসিন্দাদের উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সবুজ বাসে তুলে আমাদের এখানে আনা হলো।’

মারিয়া আল-সালান
‘চার বছর আগে ইদলিব থেকে এই আশ্রয়কেন্দ্রে আসি আমি। আমরা এ শহরেই বসবাস করছি। যখন আমরা সাবিয়াহর হামলার শিকার হই, তখন আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। তারা আমাদের তুলে নিয়ে যায়। পরে আমাদের ওপর গুলি চালায়, শিশু ও বয়স্কদের হত্যা করে তারা। রক্ত ও মৃতদেহগুলোর নিচে আমরা দুই দিন ছিলাম। আমাদের বাবার মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। মা আমাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন কিন্তু তিনিও একই পরিণতির শিকার হন।’ ‘আমার ভাই-বোনেরা বেঁচে আছে কি না দেখতে গিয়েছিলাম। তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল এবং পরে তারাও মারা যায়।’

তথ্যসূত্র : আলজাজিরা অনলাইন

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn