তুহিনুল হক তুহিন –

সিলেট জেলা ও মহানগর পুলিশের থানাগুলোতে কয়েক বছর থেকে হালনাগাদ হচ্ছে না অপরাধীদের ক্রাইম বোর্ড। যার কারণে অপরাধীরা অনেকটাই বেপরোয়া। আগে থানাগুলোয় প্রবেশ করলেই চোখে পড়তো নোটিশ কিংবা ক্রাইম বোর্ড। জরুরি নোটিশ ছাড়াও থানাগুলোর চিহ্নিত ও শীর্ষ অপরাধীদের ছবিও সাঁটানো থাকতো এতে। সতর্ক করতে এবং পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে সাধারণ মানুষের সহায়তা পাওয়াই ছিল এ কাজের প্রধান উদ্দেশ্য।

থানায় এখনও বোর্ড আছে, তবে তা আর হালনাগাদ হয়না। এছাড়াও জেলা ও মহানগর পুলিশের অধিকাংশ থানা ও ফাঁড়িতে ক্রাইম বোর্ড’ই নেই। এমনকি অপরাধীরা পুলিশের সাথে সখ্যতা গড়ে থানার ক্রাইম বোর্ডে তাদের সাঁটানো ছবিও সরিয়ে নিচ্ছে। সিলেট মহানগর পুলিশের উত্তর বিভাগে রয়েছে কোতোয়ালি, জালালাবাদ ও বিমানবন্দর থানা আর দক্ষিণ বিভাগে রয়েছে দক্ষিণ সুরমা, মোগলাববাজার ও শাহপরাণ থানা। এছাড়াও ৬টি থানাধীন রয়েছে ৮টি পুলিশ ফাঁড়ি। আর জেলা পুলিশের আওতাধীন ১১টি থানা রয়েছে কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়িও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- সিলেটের জেলা ও মহানগর পুলিশের ফাঁড়িসহ থানাগুলোতে নেই পুলিশের ক্রাইম বোর্ড। মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় অপরাধীদের ক্রাইম বোর্ড থাকলেও তা আর হালনাগাদ হয়না। এ থানায়ানায় ক্রাইম বোর্ড থাকলেও এতে সাঁটানো আছে ৫-৬বছর আগের অপরাধীদের ছবি।

ক্রাইম বোর্ডে সাঁটানো ছবির অপরাধীরা এখনও অপরাধের সাথে জড়িত আছে কিনা বা কেউ মারা গেল কিনা সেসব খবরও নেই ক্রাইম বোর্ডে। এদিকে সিলেট মহানগর পুলিশের অপরাধ জোন হিসেবে খ্যাত দক্ষিণ সুরমা থানায় নেই কোন অপরাধীদের ক্রাইম বোর্ড।এমনকি বর্তমানে সিলেট জেলা ও মহানগর থানাগুলোতে শীর্ষ অপরাধীসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধীদের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেলেও সে সকল অপরাধীর ছবি এখন আর বোর্ডে থাকে না। তবে পুলিশ বলছে, থানাগুলো এখন ডিজিটাল। তবে সেই তালিকা শুধু দেখতে পারে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তারা।

সিলেট মহাগনরের থানাগুলোয় শীর্ষ অপরাধীদের ছবি দৃশ্যমান স্থানে না থাকার ভিন্ন ভিন্ন কারণের কথা বলেছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। কেউ বলছেন, থানাগুলো ডিজিটাল হয়েছে, যে কারণে ক্রাইম বোর্ডে অপরাধীদের তালিকা না টাঙিয়ে অনলাইনে ডাটাবেজ করা আছে। আবার কেউ বলছেন, আগের মতো দাগী অপরাধী নেই, তাই বোর্ডে ছবিও নাই।সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরীয়া জানান- কারও বিরুদ্ধে থানায় মামলা হলেও তা সিডিএমএস-এ রাখা হয়। প্রতিটি থানাতেই অপরাধীদের ডাটাবেজে আছে। সিলেটের অপরাধীদের ডাটাও আমাদের কাছে রয়েছে। থানাগুলোর ক্রাইম বোর্ড হালনাগাদ না হওয়া বিষয়ে তিনি বলেন-এখানে মানবাধিকার কিছু বিষয় রয়েছে।

সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালের পাবলিক প্রসিকিউটর কিশোর কুমার কর জানান- যারা মোস্ট ওয়ানটেড অপরাধী তাদের ছবি ক্রাইম বোর্ডে সাঁটানো প্রয়োজন আছে। যার ফলে অপরাধীরা অপরাধ করতে গেলে মনে ভয় থাকবে। আর অপরাধীদের ছবি দেখে সাধারণ মানুষ সহজেই অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি সেই অপরাধী সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঠিক তথ্যও দিতে পারবে। থানার কর্মকর্তাদের সদিচ্ছার কারণেই ক্রাইম বোর্ড হালানাগাদ হয়না জানিয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) জেদান আল মুসা জানান- পুলিশের কাছে এমনিতেই অপরাধীদের সব রকম তথ্য থাকে। তবে থানার ক্রাইম বোর্ডগুলো হালনাগাদ করলে আরও ভালো হয়।

সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গৌছুল হোসেন বলেন- প্রতিটি থানাতেই অপরাধীদের ডাটাবেজে আছে। অপরাধীদের ছবি আমরা যেসময় পাই সেসময় ক্রাইম বোর্ডে লাগানো হয়। অপরাধীদের ছবি আমরা যেসময় পাই সেসময় ক্রাইম বোর্ডে লাগানো হয়।সিলেট মহানগর পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান- কোন এলাকায় কি ধরণের অপরাধী আছে সেসব বিষয় নজর রাখে সিটিএসবি। তাদের কাছে তথ্যও তাকে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় বড় কোন ঘটনা ঘটলেও সিএসবি পুলিশের কাছেও তেমন কোন তথ্য ছিলনা। এসবের ক্ষেত্রে সিলেট নগর সিটিএসবিকে আরও গতিশীল হতে হবে। তিনি আরও জানান-সিডিএমএস-এ অপরাধীদের ডাটা প্রতিটি থানাতেই এন্ট্রি করা হয়। যার বিরুদ্ধে যত মামলা হয় সব এই সিডিএমএস এ লিপিবদ্ধ থাকে। একবার কারও নামে মামলা হলে সেটা সিডিএমএস এ ওঠে। ফলে এইক ব্যক্তি আবার অন্য কোথাও গ্রেফতার বা মামলা হলে তার নামে দেশের অন্য থানাগুলোতে যত মামলা আছে সেগুলোর আপডেট তথ্য চলে আসে। যাতে করে আসামি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে সময় কম লাগছে। এটার সুফল পাওয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।’

এদিকে আবার ক্রাইম বোর্ডে ছবি প্রকাশ করা নিয়ে হাইকোর্টের এক রুলের ব্যাপারে অপস্পষ্টতা রয়েছে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে। যদিও ২০১২ সালের দেওয়া রুলে বলা হয়েছে, ‘গ্রেফতারকৃত বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটক ব্যক্তিকে স্বীকারোক্তি প্রদানের জন্যে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা যাবে না। কারণ প্রেফতারকৃত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারেন। তাই বিচারের আগে তাকে মিডিয়ার সামনে হাজির করা শুধু মিডিয়া ট্রায়ালই নয়, এটা মিডিয়া কনভিকশনও বটে।’ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা: ফারুক উদ্দিন বলেন- থানার ক্রাইম বোর্ডে অপরাধীদেও ছবি সাঁটানো থাকলে অপরাধীর সংশোধন হওয়া অনেকটা কমে যায়। কারণ এখানে ছবি প্রকাশিত হলে তার আরও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। অপরাধ থেকে সে আর কখনও বের হতে পারবেনা। সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও আশংকা থাকে।

সিলেট গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান-‘তালিকা বা ছবি রাখার মূল উদ্দেশ্য ছিল লোকজন তাদের দেখবে, নাম জানবে। যাতে পরবর্তীতে তাদের কোথায় দেখলে বা সন্ধান পেলে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে। এতে পুলিশ আসামি গ্রেফতারে সাধারণ জনগণের সহায়তা পাবে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরন পাল্টেছে, অপরাধীদের সংখ্যাও বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, অপরাধ দমনের জন্য আইন রয়েছে। সেই আইনের প্রয়োগ যথাযথ করতে হবে বা প্রয়োগ করতে দিতে হবে। তাহলেই অপরাধ দমন সম্ভব হবে।’ তার মতে, ‘থানায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের তালিকা থাকা একটা ভ্যালু আছে। কিন্তু এটা না রেখে যদি প্রকৃত অর্থে দশটা অপরাধী ধরার কাজে সফটওয়ার বা ডাটাবেজ ব্যবহার করা হয় তাহলে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু সেই কাজ করা হচ্ছে কিনা? আমার কথা হচ্ছে, মূল কাজটা হচ্ছে- অপরাধীদের শনাক্ত করা ও তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সেটা কতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে হচ্ছে সেটা দেখার বিষয়।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn