সিলেট নগরের খরাদিপাড়ায় দুর্বৃত্তদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতেই খুন হন পার্লার ব্যবসায়ী রোকেয়া বেগম ও তার একমাত্র ছেলে রবিউল ইসলাম রোকন। লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের সময় মা-ছেলের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে আঁতকে ওঠেন সংশ্লিষ্টরা। গত রবিবার নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মিতালি ১৫/এ নম্বরের তিনতলা বাড়ির নিচতলা থেকে মা-ছেলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হেফাজতে নেওয়া হয় রোকেয়া বেগমের পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে রাইসাকে। এদিকে, হত্যাকাণ্ডের সময় বাসার কাজের মেয়ে তানিয়াসহ কয়েকজন যুবকের উপস্থিতির কথা পুলিশকে জানিয়েছে শিশু রাইসা। এখন তানিয়াকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। তাকে ধরতে পারলেই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হবে বলে আশাবাদী পুলিশ। ইতোমধ্যে পুলিশ তানিয়া ছাড়াও শিপন, সুমন ওরফে কাঞ্চা সুমন, একে পাপলু, মারুফ ও রিপনের খোঁজে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের মামলার একটি অংশে নিহত রোকেয়া বেগমের সঙ্গে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এতে ওই ৫ যুবকের নাম উল্লেখ করা হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছাত্রদলের কর্মী বলে জানা যায়। ফরেনসিক সূত্র জানায়, রোকেয়া বেগম ও তার ছেলে রোকনকে ছুরিকাঘাতেই হত্যা করা হয়। এ কারণে তাদের দুজনের শরীরে ১১২টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় ময়নাতদন্তের সময়। পুলিশও এমনটি ধারণা করছে। রোকেয়া বেগমের শরীরে ৭২টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এরমধ্যে পেটে ১৫, পিঠে ৩৫, উরুর পেছনের দিকে ১১, দুই হাতে ৩টি করে ৬টি, গলায় ৪টি এবং মাথার পেছনে একটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। রোকনের শরীরে পাওয়া যায় ৪০টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। এরমধ্যে গলার ডান দিকে ১টি, বুকের বাম পাশসহ বিভিন্ন দিকে ৪টি, পেটে ছোট-বড় ১৫, পিঠে ৩, বাম ও ডান হাতে ১৬টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, জোড়া খুনের সঙ্গে যারা জড়িত তারা মা ও ভাইয়ের সঙ্গে শিশু রাইসাকেও গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করেছিল। ওই সময় রাইসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাকে মৃত ভেবে বাসার ভেতর ফেলে রেখে ঘাতকরা পালিয়ে যায়। রাইসার গলায় আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। সেটা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতার করার পর তাদের আঙুলের ছাপের সঙ্গে সংরক্ষণ করা ছাপগুলো মিলিয়ে দেখা হবে। পুলিশ সূত্র জানায়, মা-ছেলে খুনের নেপথ্যে পুলিশ একাধিক যুবকের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে। যারা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে তারা পেশাদার খুনি। হত্যার করার সময় আশপাশের লোকজন যাতে কোনও কিছু বুঝতে না পারে, সেজন্য অনেক সময় নিয়েই তারা পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে অনায়াসে পালিয়ে যায়। পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা রোকেয়া বেগমের খুবই পরিচিত। কারণ, তার বাসায় ছেলে ছাড়া আর কোনও পুরুষ থাকতেন না। তবে রোকেয়া বেগমের ছেলে স্থানীয় মুদি দোকান ‘শারমিন স্টোর’ থেকে সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই বাসায় বেনসন সিগারেট নিয়ে যেত। এমনকি ঘটনার দিনও রোকেয়া বেগমের বিছানার পাশে থাকা টেবিলের ওপর বেনসনের খালি দুটি প্যাকেট পায় পুলিশ। এগুলো কাদের জন্য নেওয়া হতো তাও গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছে পুলিশ। সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের এক চিকিৎসক জানান, প্রাথমিকভাবে তারা নিশ্চিত রোকেয়া বেগম ও তার ছেলে রোকনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। একেকটি ছুরিকাঘাত অনেক গভীর। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল ওয়াহাব (গণমাধ্যম) জানান, মা ও ছেলের শরীরের পুলিশ সুরতহাল প্রস্তুতের সময় শতাধিক ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পেয়েছে। তাদের ছুরিকাঘাত কিংবা অন্যভাবে হত্যা করা হয়েছে কিনা সে বিষয়টি জানা যাবে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জানান, রাইসার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ । তবে তার মা ও ভাইকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। পুলিশের ধারণা, দুজনকেই ধারালো ছোরা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদের বিছানা ও মেঝেতে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর বিস্তারিত জানা যাবে। নিহত রোকেয়া বেগমের মেয়ে রাইসা এখনও পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn