সুজাত মনসুর-
সুনামগঞ্জের রাজনীতিতে এ সপ্তাহের তাজাখবর হলো, সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের নতুন মেরুকরন। এই মেরুকরণ যে হবে তা কিছুদিন যাবতই টের পাওয়া যাচ্ছিল এবং তা না করে সভাপতি-সম্পাদকের আপাততঃ দ্বিতীয় কোন পথ খোলা ছিল বলে মনে হয়না। কেননা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ থেকে নাকি তাগাদা দেয়া হচ্ছে জরুরী ভিত্তিতে জেলা আওয়ামী লীগের পুর্ণাঙ্গ কমিটি করতে হবে নতুবা কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। এটা অবশ্যই শোনা কথা, সত্যতা যাচা্ই করিনি কিংবা প্রয়োজনবোধ করিনি। মেরুকরনের আরেকটি কারণ হলো, সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র আইয়ুব বখত জগলুর সাথে সাম্প্রতিককালে জেলা সভাপতি আলহাজ্ব মতিউর রহমান ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকু্টের সম্পর্কের টানাপোড়েন। সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সাংসদ জেলা সভাপতি মতিউর রহমানের বিপরীতে আসন্ন নির্বাচনে আইযুব বখত জগলুর প্রার্থীতা ঘোষণা ও জেলা কমিটিতে সিনিয়র সহসভাপতি পদ নিয়ে নুরুল হুদা মুকুট এবং আইয়ুব বখত জগলুর প্রতিদ্বন্ধিতা তাঁদের সম্পর্কের অবনতির মূখ্য কারণ। অন্যদিকে, আইযুব বখত জগলুর সাথে জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদকের বিরোধ অনেক পুরনো। এই বিরোধ মূলতঃ ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। নুরুল হুদা মুকুটের সাথেও আইযুব বখত জগলুর দীর্ঘদিন বিরোধ ছিলো স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে। এই বিরোধের আরেক কারণ ছিলো, আব্দুস সামাদ আজাদের সাথে জগলুর বিরোধ। যদিও, জগলুর বাবা মরহুম হোসেন বখত সারাজীবনই সামাদ আজাদের শিষ্যত্ব মেনেই রাজনীতি করেছেন। এবং একটি প্রচলিত গুজব আছে সেই শিষ্যত্বের পুরষ্কারস্বরূপ হোসেন বখত সাহেবের বড় ছেলেকে নাকি সামাদ আজাদ বিদেশে যেতে সহায়তা করেন। কিন্তু গত জেলা সম্মেলনের পর, বিশেষ করে জেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুকুট-জগলুর মধ্যে একটা কমন পয়েন্টে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সে ঐক্য প্রক্রিয়ায় ভুমিকা রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান। কমন পয়েন্ট হলো শত্রুর শত্রু মিত্র ফর্মূলা। অর্থাৎ জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন ঠেকাও প্রকল্প। ইমন যেহেতু দুইজনের শত্রু, সুতরাং দুইজনই চাইলেন তাকে বদ করতে। সাথে রইলো জেলা সভাপতির আশির্বাদ। ইমন বধে দুজনই, দুজনকে ব্যবহার করলেন। যা রাজনীতির জন্য কোন অবস্থায়ই সুস্থতার লক্ষণ নয়। তারপরও এ প্রক্রিয়া শুধু সুনামগঞ্জে নয়, সারাদেশেই বিরাজমান।

তরুণ ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগ রাজনীতির তিন দিকপালের ঠ্যালা সামলাতে আশ্রয় নেন প্রয়াত সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সহ জেলার পাঁচ এমপির, যাদের চিরকালীন শত্রু হলেন মতিউর রহমান ও নুরুর হুদা মুকুট। যদিও সুনামগঞ্জের রাজনীতিতে সামাদ আজাদ বিরোধী একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেবার কারনে জগলু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের খুব কাছের মানুষ ছিলেন, তথাপি তিনি ইমন বধ প্রকল্পে সেনগুপ্তের গ্রুপের বিপরীতেই অবস্থান নেন। জেলা কমিটিতে পদবঞ্চিত এমপিরাও ইমনকে কেন্দ্র করে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগে তাদের অবস্থান সংহত ও শক্তিশালী করতে ঐক্যবদ্ধ হন। জেলা পরিষদ নির্বাচনে তারা ব্যারিস্টার ইমনকে জিতিয়ে আনতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এমনকি সকল প্রকার নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন করে প্রয়াত সেনগুপ্ত অসুস্থ শরীর নিয়েও হেলিকপ্টারে চড়ে নির্বাচনের দুদিন আগে নিজ নির্বাচনী এলাকা সফর করেন। এমনকি মহিবুর রহমান মানিক এমপির বিরুদ্ধেও নুরুর হুদা মুকুট আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ করেন। এতকিছু করার পরও কিন্তু তারা সফল হতে পারেননি। ইমন বিপুল ভোটের ব্যবধানে মুকুটের নিকট পরাজিত হন। এরপর থেকে মূলতঃ ইমন সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় বিতাড়িতই ছিলেন। শুধু তাই নয়, অন্যান্য এমপিদেরও সুনামগঞ্জ সদরে সভাসমাবেশগুলোতে যোগদান করতে তেমন দেখা যায়নি। তাই হয়তো ইমন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন কিভাবে মতিউর-মুকুট-জগলুর ঐক্যে ফাঁটল ধরে আর তিনি সে ফাটল ভেদ করে ঢুকে পড়বেন, তিনি তাই করেছেন। তিনিও শত্রুর শত্রু মিত্র ফর্মূলা অনুসরণ করে গত ২৫শে নভেম্বর ঐতিহাসিক সাতই মার্চকে ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় পালিত অনুষ্ঠানে মতিউর-মুকুটের সাথে হাত মিলিয়ে জগলু বধ প্রক্রিয়ায় সংহতি প্রকাশ করেছেন। যদিও তারা বলছেন, সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করে জেলার ৫টি আসনই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে চান। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? নাকি কোথাও শুভঙ্করের ফাঁকি আছে? (চলবে)

এখানে প্রকাশিত সব মতামত লেখকের ব্যক্তিগত,  সুনামগঞ্জ বার্তা ডটকম’র সম্পাদকীয় নীতির আওতাভুক্ত নয়।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn