নূরুজ্জামান শাহী–(ফেসবুক থেকে)–

শরীরে অসংখ্য বাদ অসুস্থতা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে সরে আছি। দূরে সরে থাকলেও অনেক সময় অনেক কিছু থেকে দূরে থাকা যায়না। রাজনীতির গতি প্রকৃতি আমাকে এখনো ভাবায়। কলেজ জীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িত। এক সময় ছাত্রলীগ সুনামগঞ্জ মহকুমার সভাপতি ও ছিলাম। বঙ্গবন্ধু আদর্শে শুরু থেকে শুরু। আজ অবদি সেই আদর্শে অবিচল। ছাত্রলীগ করার অপরাধে বাসায় ডুকে দিনে দুপুরে সন্ত্রাসীররা আমার নিরপরাধ ধার্মিক বাবা মাকে কুপিয়ে জখম করলো। জখমের ক্ষত নিয়ে সারা জীবিন তারা বেচেছিলেন। আমিও সারা জীবন সেই জখমের ক্ষত দেখেদেখে অনুশোচনায় ভুগেছি। দল কি দিয়েছে নয় দলকে কি দিয়েছি তাই নিয়েই ভাবতাম। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ ও ছাত্রলীগকে সংঘটিত করার চেষ্টা করার অপরাধে সামরীক জান্তা জিয়াউর রহমানের কারাগারে মাসের পড় মাস কাটালাম। নিজ ও পরিবারে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ৭৯ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে হল্যান্ড হয়ে জার্মান পালিয়ে এলাম। জার্মান থেকে এক সময় আমেরিকা। সেই থেকে আজ অবধি আমেরিকা প্রবাসী।

প্রাণের সংগঠন আওয়ামীলীগ ১৮ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে থাকে। আওয়ামীলীগ ক্ষমতার ফিরে না আসা পর্যন্ত আমার আর দেশে ফেরা হয়নি। দেশে পা না রাখলেও রাজনীতি থেকে মুখ ফেরাতে পারিনি। জার্মান হোক আর আমেরিকা রাজনীতি সবখানে তাড়াকরে ফিরে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করি বলে দলের পতাকা আর কালো মুজিব কোট কখনো ছিড়ে ফেলতে পারিনি। জার্মান,আমেরিকা যেখানেই হোক শক্ত হাতে হাল ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। সচল ছিলাম যতদিন দলের প্রয়োজন ছিল ততোদিন। রাজনীতি যারা করে তারা রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া মানেই জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া। আমার কাছে ইদানিং তাই মনে হয়। মনে হয় আমিও জীবন থেকে হারিয়ে গেছি। দৈহিক ভাবে অনেক কিছু থেকে সরে থাকা সহজ হলেও মন থেকে অনেক চেষ্টা করেও অনেক কিছু থেকে সরে থাকা যায় না।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক একটা বাংলাদেশ চেয়ে ছিলাম আমরা। ৭১ সালের নয়মাস ভারতে থেকে দিনকে রাত আর রাতকে দিন দেখেছি । স্বপ্ন শুধু একটাই ছিল। আমরা মুক্তি পাবো। মুক্তি আসেনি। ৭৫ সালের পর দেশে কালো অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল । বঙ্গবন্ধুর কন্যা শক্ত হাতে হাল ধরায় আমরা সেই বিভিষিকা থেকে আজ বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছি। স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।

৭১ সালে যুদ্ধ শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল না। ছিল মুক্তির জন্য যুদ্ধ। মানুষ যুদ্ধ করেছিলো। আর তা ছিলো ‘মুক্তির’ যুদ্ধ। আর সেই মুক্তি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। আজ আমরা সেই মুক্তির পথেই হাটছি। ভালো লাগে দেশ যখন ভালো থাকে। তবে খারাপ লাগে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদের খারাপ অবস্থা দেখে। রাজনীতি এখন এমন এক জায়গায় এসে গেছে এক সময় রাজনীতি করতাম বলতেও সংকোচ বোধ করি। ৭০ দশকে যখন ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত ছিলাম তখন রাজনীতিবিদদের নিয়ে মানুষ ইতিবাচক চিন্তা করতো এখন নীতিবাচক মনোভাব পোষন করে। রাজনীতি আর রাজনীতিবিদের সজ্ঞাই যেনো বদলে গেছে।

আমি এক সময় লিখতাম। এখন আর লিখিনা। লিখার অভ্যাস হারিয়েগেছে। ৪০ বছর থেকে দেশের বাইরে থেকে থেকে ভাষা জ্ঞানও প্রায় তলানিতে। আজকে হঠাৎ করে আমার এই লিখা। লিখারও একটা কারন আছে। কোন কিছুই কারন ছাড়া ঘটেনা। আমার এই লেখারও একটা কারন আছে। যাদেরকে ম্যাসেজ দেবার জন্য আমার এ লেখা যদি তা তাদের নজর কাড়ে তাহলে মনে করবো লেখাটা সার্থক হয়েছে।

কিছু দিন আগে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হলো। ১৮ বছর পর দলের কাউন্সিল। আর আরো কতো বছর পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ভালো কথা আমার এতে কোন আপত্তি নেই। আর আমি আপত্তি করার বা কে? তবে একসময় সংগঠনের করতাম। দেশে বিদেশে অনেক সময় দলের দায়িত্বশীল পদেও ছিলাম বলে পুরাতন দাবী নিয়ে লিখছি। নেতৃস্থানীয় যারা তাদের উদ্দেশ্যে দু’একটা কথা বলার জন্যই লিখা। প্রায় ৪০ বছরের উপরে আমি দেশ ছেড়ে প্রবাসে। বিরাট এক শূণ্যতা। দেশের অনেককে চিনি । অনেককে চিনি না। আমার আগে অনেকে আওয়ামীলীগ করেছেন। অনেকে আমার পরে আওয়ামীলীগে এসেছেন। কেউকেউ আমার সহযোদ্ধা ছিলেন। আমি যাদেরকে চিনি। তাদেরকে নিয়ে আমি বলতে পারি। অন্যদের নিয়ে আমার কথা বলার অধিকার নেই।

জেলা আওয়ামীলীগের নব ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অনেকের স্থান হয়েছে আবার অনেকের স্থান হয়নি। নেতাদের কাছে যোগ্যতার মাপকাটিতে যারা যোগ্য বলে বিবেচিত হননি তারা বাদ গেছেন আর যারা যোগ্যতার পরীক্ষায় পাশ করেছেন তারাই স্থান পেয়েছেন। তবে আমি এই মাপকাটি নিয়ে একটু কথা না বলে পারছিনা। বিশেষ করে আমার সময়ের ছাত্র রাজনীতির দু’জন ভ্যানগার্ডকে নিয়ে কথা বলতে চাই। এই দু’জন সেই সত্তর দশক থেকে আওয়ামী ঘরনার লোক। দলের জন্য নিবেদিত অন্তঃপ্রান। ঝড় তুফানে তারা ভেঙে যায়নি। আদর্শ থেকে এক চুল নড়েনি। দলের প্রভাব খাটিয়ে, দলের সাইনবোর্ড বিক্রি করে চলেনি। বিগত কমিটিতে গুরুত্ব পূর্ণ পদে থাকলেও কি অপরাধে বর্তমান কমিটি থেকে তাদেরকে বাদ দেয়া হলো বোধগম্য নয়। কি অযোগ্যতায় তারা অযোগ্য হলেন তাও জানিনা।

সুরমা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, থানা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক, সাবেক মহকুমা যুবলীগের সভাপতি। জেলা কমিটিতে বারবার স্থান পাওয়া আমির হোসেন রেজা এবং মহকুমা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক কৃষি বিষয়ক সম্পাদক মতিউর রহমান পীরের কথা আমি বলছি। আমীর আর মতিকে নিয়ে আমি রাজনৈতিক মাঠে হাল চাষ করেছি। আমীর নিজের জীবনবাজী রেখে দলের জন্য যুদ্ধ করেছে। আজো সে সেই যুদ্ধের মাঠে আছে। যাদের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ছিলো তারা আজ কমিটিতে। আমীর কমিটির বাইরে। দলের জন্য যার রক্ত ঝরে সে সামান্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রতীক পাবার অধিকার রাখেনা। রাখে কে?

মতি পীর না থাকলে ৭৫ সালের পর যে শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছিলো ছাত্রলীগের সেই শূণ্যতা কে পূরণ করতো? একজন সাহসী মানূষ খোঁজে পাইনি যাকে আমি দায়িত্ব দিয়ে আসবো। ৭৫ সাল থেকে কয়েক বছর সামরীক জান্তার ভয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম কেউ মুখে নিতে সাহস পেতো না। মতির মতো সাহসীরা ছিলো বলে আমি সাহস পেয়েছিলাম। ঘরোয়া রাজনীতির অনুমোদন দেওয়ার পর মতির হাতে মুজিবের আদর্শের ঝান্ডা তুলে দিয়ে আসতে পেরেছিলাম। মতি এক চুল পরিমান তার নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুৎ হয়নি। ক্ষমতা হাতছানি দিয়ে ডাকলেও মতি নিজ দলের সাথে বেইমানী করেনি। দলের প্রতি ‘লয়েল থাকাটাই কি তার অযোগ্যতা? সে অযোগ্যতাই কি তার কমিটিতে পদ না পাওয়ার কারন? আমি কাউকে দোষারূপ করছি না। হয়তো কারো ভুল হতে পারে। হয়তো অজ্ঞতা হতে পারে। শুধরে নিলে অপমানের কিছু থাকে না। উদারতা মানুষকে ছোট নয়, মহান করে। আমরা কি মহান হতে পারিনা?

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn