হাওরবেষ্টিত জামালগঞ্জ-ধর্মপাশা-তাহিরপুর ও মধ্যনগর নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ-১ আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা গ্রামে গ্রামে প্রচারণায় সরব হয়ে উঠেছেন। আওয়ামী লীগ থেকে এখন পর্যন্ত আট ও বিএনপি থেকে সাতজন মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে প্রচারণায় রয়েছেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি, জমিয়তে উলামা ইসলামসহ অন্য দলের প্রার্থীরাও নির্বাচনী মাঠে কাজ করছেন। তবে এ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৫ নেতা থাকায় ‘ধানের শীষ আর নৌকা’ নিয়ে উভয় দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে চলছে রশি টানাটানি। কে হবেন নৌকার মাঝি আর ধানের শীষ যাবে কার হাতে; এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে চলছে তুমুল আলোচনা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নিজেদের প্রার্থিতার কথা বলছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে লবিং করছেন। মনোনয়ন দৌড়ে কে কাকে টপকে যাবেন এ নিয়ে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা।

১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের মো: আবদুল হেকিম চৌধুরী, ১৯৭৯ সালে একতা পার্টির সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ১৯৮৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির (নৌকা প্রতীকে) প্রসূন কান্তি রায় (ররুণ রায়), ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির বদরুদ্দোজা আহম্মেদ সুজা, ১৯৯১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির (নৌকা প্রতীকে) নজির হোসেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সৈয়দ রফিকুল হক সোহেল, ২০০১ সালে বিএনপির নজির হোসেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ২০১৪ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন জয়ী হন। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে প্রচারণায় রয়েছেন বর্তমান এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সাবেক এমপি সৈয়দ রফিকুল হক সোহেল, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাচনাবাজার ইউপির দু’বারের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শামীম, সাবেক যুগ্ম সচিব বিনয় ভূষণ তালুকদার, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রণজিৎ সরকার, সুনামগঞ্জ জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের আহ্বায়ক ড. রফিকুল ইসলাম, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান সেলিম ও জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কৃষকলীগ নেত্রী শামীমা শাহরিয়ার।

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণায় রয়েছেন সাবেক এমপি জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নজির হোসেন, দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা: রফিক চৌধুরী, তাহিরপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জেলা বিএনপির সহসভাপতি মো: আনিসুল হক, তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান কামরুল, ধর্মপাশা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি মো: আবদুল মোতালিব খান, যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার হামিদুল হক আফিন্দী লিটন ও মামুনুর রশিদ শান্ত। এ দুই দলের বাইরে জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সহসভাপতি সাধন ভৌমিক, জমিয়তে উলামা ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা তাফাজ্জুল হক আজীজ ও একই দলের কেন্দ্রীয় শ্রমবিষয়ক সম্পাদক জামালগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ রশিদ আহম্মদ সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে গণসংযোগ করছেন। এ ছাড়া রয়েছেন সাবেক এমপি বদরুদ্দোজা আহমদ সুজা। তিনিও গণসংযোগ করছেন।

সুনামগঞ্জ-১ আসনের বর্তমান এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, প্রচারণা যে কেউ চালাতে পারেন; তবে মনোনয়ন দেয়ার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। আমার বিশ্বাস আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এলাকার উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত করতে নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করব। নৌকা প্রতীকের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক এমপি সৈয়দ রফিকুল হক সোহেল বলেন, আমি যখন এমপি ছিলাম, তখন যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে হাওর এলাকায়। স্মরণকালের অকাল বন্যায় দুর্যোগে ভাটি অঞ্চলের মানুষের পাশে গিয়ে সাহস জুগিয়েছি। দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আমাকে মনোনয়ন দেন, তাহলে আমি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি। এলাকায় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে আমার। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল করিম শামীম বলেন, দলের জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করেছি। তৃণমূলে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে শক্তিশালী অবস্থানে রেখেছি। নির্বাচনী এলাকায় আমার জনমত রয়েছে। তৃণমূল নেতাকর্মী ও দলীয় সমর্থকেরা আমাকে নির্বাচন করতে উজ্জীবিত করছেন। এ আসনে দলকে আরো শক্তিশালী করতে নেত্রীর কাছে আমি নৌকা মার্কা চাইব। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক রণজিৎ সরকার বলেন, এলাকায় আমার জনপ্রিয়তা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবার আমাকে নিরাশ করবেন না। অন্য দিকে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা সুনামগঞ্জ-১ আসনটি উদ্ধারে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে নিয়ে মরিয়া হয়ে প্রচারে নেমেছেন। দলটির সাবেক এমপি নজির হোসেন বলেন, দেশ এখন একটি কারাগারে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি সংগ্রামে সম্পৃক্ত আমরা। তার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত অন্য কোনো ইস্যু আমাদের সামনে নেই। এমনকি নির্বাচনে প্রার্থিতা আমাদের সামনে নেই। ডা: রফিক চৌধুরী বলেন, দলের জন্য জেল-জুলুম সহ্য করছি। ধানের শীষ নিয়ে সুনামগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। আমার বিশ্বাস দলের চেয়ারপারসন এবার আমাকেই বিএনপির প্রার্থী করবেন। অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও তাহিরপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুল হক বলেন, ওয়ান-ইলেভেন থেকে শুরু করে সব আন্দোলনে সোচ্চার আছি। এ মুহূর্তে বেগম জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন করে যাচ্ছি। সুনামগঞ্জ-১ আসনে সব আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে ত্যাগী নেতাকর্মীদের নিয়ে কাজ করছি। কেন্দ্রীয় নেতারা আমাকে মূল্যায়ন করবেন বলে আশা করছি।

তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, এ মুহূর্তে দাবি একটাই ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি। তিনি বলেন, তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকদের চাপে সংসদ নির্বাচন করতে মাঠে প্রচার চালাচ্ছি। মনোনয়নের আশায় আমি দলীয় নেতাকর্মী নিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে গণসংযোগ করছি। ধর্মপাশা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবদুল মোতালিব খান বলেন, সব সময় মূল ধারার সাথে ছিলাম। এখনো আছি। অতীতে যারা দলের ঘোর বিরোধিতা করেছেন আশা করি কেন্দ্রীয় নেতারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবেন। মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে আছি। দলের স্বার্থে প্রতিটি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় সংগঠন সুসংগঠিত করতে গণসংযোগ করছি। আশা করি কেন্দ্রীয় নেতারা আমাকে মূল্যায়ন করবেন। সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকায় ভোটারসংখ্যা চার লাখ ছয় হাজার পাঁচ। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ চার হাজার ১৪০ এবং নারী ভোটার দুই লাখ এক হাজার ৯৬৫। উপজেলা অনুযায়ী জামালগঞ্জে ভোটারসংখ্যা এক লাখ ১৪ হাজার ৭৮৮, ধর্মপাশায় এক লাখ ৫৭ হাজার ৪৮৮ ও তাহিরপুরে এক লাখ ৩৩ হাজার ৮২৯। এ আসনের ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সুনামগঞ্জ-১ আসনে মহাজোট বনাম ২০ দলীয় জোট প্রার্থীর মধ্যে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn