নজিরহোসেন  (সাবেক সংসদ সদস্য ,সুনামগঞ্জ -১) এর ফেসবুক থেক-

আশির দশকে শহর ও হাওড় অঞ্চলে গড়ে ওঠা বীরত্বপূর্ন আন্দোলন ও সংগ্রাম(স্বৈরাচার বিরুধী ও ভাসান পানি আন্দোলন) গুলি নিয়ে লিখবো ভাবছিলাম ৷কিন্তু হঠাৎ সুফিয়ানের না ফেরার দেশে চলে যাওয়া (ইন্নালিল্লা ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ) এই তাগিদটাকে সামনে নিয়ে এল ৷ আমার সাথে অভিমান ছিল রাগ ছিল ৷রাগ অভিমান না ভেঙ্গেই না ফেরার দেশে চলে গেল ৷ সেই ১৯৯৫ সালের পর থেকে আমার সামনেও আসেনি ফোন দেয়নি ৷ আমি ফোন দিলে নো আনসার আসতো ৷মাঝ খানে একবার ফেইসবুকে যোগযোগ হয়েছিল ৷আমি ১৯৯১ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হওয়ার পর আমার কাছে কি আবদার ছিল আমি পুরন করতে সময় নিয়েছিলাম সে অভিমানে তপ্ত হয়ে গিয়েছিল ৷ ফেইসবুক যোগাযোগ অভিমান রাগের কারনটা জানতে পারলাম ৷আমি ১৯৯৪ সালে বিএনপিতে যোগ দিই ৷ তখন আমার সব কাজ কর্ম নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক হয়ে পড়ে ৷ আমরা দুজন একপার্টিতে নেই কেন সে উত্তরটা দাবী করলো ফেইসবুক আলোচনায় ৷

সুনামগঞ্জ শহরে আমার একটা বিশাল আন্দোলন ভিত্তিক অতীত ছিল ৷৬৯ গনঅভ্যুত্থান, গোপন কমিনিষ্ট পার্টির কাজ, সত্তরের নির্বাচন ,৭১ মুক্তি যুদ্ধ,স্বাধীনতার পর সোনার বাংলা গড়ে তোলায় আত্ম নিয়োগ,৭২ সালে প্রকাশ্য কমিউনিষ্ট পার্টির সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সম্পাদক হওয়া,১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত আত্মগোপন ,আশির দশকে এরশাদ বিরুধী আন্দোলন সব মিলিয়ে সুনামগঞ্জ শহরভিত্তিক বিশাল জনভিত্তি কর্মী সমর্থক গড়ে ওঠেছিল ৷ কিন্তু এমপি হয়েই এই কর্মী সমর্থক গোষ্টিরা একটা দূরত্ব অনুভব করতে থাকেন ৷ এর মধ্যে আবুসুফিয়ান ছিল একজন ৷সংসদ কাজে অংশ গ্রহন,তদবির,উন্নয়ন কর্ম,এলাকায় জন যোগাযোগ এইগুলির ফলে সুনামগঞ্জের কর্মীদের সাথে গ্যাপ হয়ে যায় ৷

৮০ দশকে ছাত্রইউনিয়নের নেতা হিসেবে আমার সাথে একান্ত আন্তরিক হয়ে যায় আবুসুফিয়ান ৷ছাত্রইউনিয়নের অগ্রসর নেতা কর্মীকে কমিউনিষ্ট পা্টি টারগেট করতো এবং ট্রেনিং প্রশিক্ষন এবং মটিভেশন এর মাধ্যমে নেতৃত্ব ও আন্দোলন গুনাবলী গড়ে তোলার চেষ্টা করতো ৷আবসুফিয়ান ছিল টার্গেট গ্রূপের একজন ৷আমার সাথে একটা পারিবারিক সম্পর্কের মত করে চলতো ৷ মিছিল মিটিং এ আমার পাশে পাশে থাকতো ৷ ভাল একজন সংগঠক ছিলেো ৷মিছিলে ,জনসভায়,প্রভাত ফেরীতে লোক জমায়েতের দক্ষতা ছিল নিজে বক্তব্য না দিয়ে অন্যদের এগিয়ে দিত ৷আমার প্রতি ছিল একান্ত অনুগত ৷ আশির দশকে এরশাদ স্বৈরাচার বিরুধী আন্দোলনে আবুসুফিয়ান ছাত্র নেতাদের মধ্যে একজন দুদর্ষ কর্মিতে পরিনত হয় ৷এদের কয়েকজনকে ছাত্ররা চার কুতুব ডাকতো ৷ বাপটু,আবুসুফিয়ান,জালাল,মিসবা জগলু,নাদের গং আরো কয়েকজন ছিল আন্দোলনের অগ্রসর অংশ ৷

১৯৮৪ সালে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের ডাক দেওয়ায় ১৫দল,৭দল ,৫দলীয় জোটের নেতা কর্মী সমর্থকরা এরশাদ স্বৈরাচারের সাথে তীব্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে ৷উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সাহেব বাড়ীর প্রার্থির সাথে একটা সংঘর্ষ বেধে যায় ৷এতে উপজেলা প্রার্থী সাবেরীন (সম্ভবতঃ) সামান্য আহত হন ৷ মামলা হয় ৷বরুনবাবুর কল্লা চাই ,নজিরের কল্লা চাই শ্লুগান নিয়ে শহরে একটা বিভৎস মিছিল হয়েছিল ৷আসলে সুফিয়ান গং রাই ছিল উপজেলা নির্বাচনের প্রতিহত করায় মিলিটেন্ট অংশ ৷

স্বৈরাচার বিরুধী আন্দোলনে শহরে ছাত্র জনতার মিছিল সরগরম করে রেখেছিল ৷ ঐসময়ে কমিউনিষ্ট পার্টির সিদ্ধান্তে সারা হাওর অঞ্চলে ভাসান পানিতে মাছ ধরার দাবীতে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ৷অনেক হাওড়ে সংগ্রাম স্বশস্ত্র রুপ নেয় ৷ আমি কমিউনিষ্ট জেলা সম্পাদক সার্বক্ষনিক হউলটাইমার ৷আমার উপড় ২টা আন্দোলনের সমন্নয়ের দায়িত্ব পড়ে ৷ভাসান পানিতে মাছ ধরার আন্দোলনে আমরা ১৫দলের সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহন আদায়ে সমর্থ হই ৷১৯৮৫ সালেই আমরা জেলায় আন্দোলনকারী শক্তি শহরের রাজপথ,গ্রামের মেটোপথ এবং হাওড়ের জলরাশি তে আমাদের ধাপট প্রতিষ্টিত করি ৷ আমাদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে টিকতে না পেরে পুলিশের সাহায্য নেয় ইজারাদাররা ৷সংঘবদ্ধ সুসংগঠিত জেলেরা হাওড়ে পুলিশের নৌকা ঘেরাও করে ওদের অস্ত্র সারেন্ডার করে ৷আমি দ্রুত এই সমস্ত জায়গায় গিয়ে মীমাংসা করে আসতাম ৷১৯৮৫ সালের মে জুন হবে হয়তো তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওড় পাড়ে বিন্ননগর গ্রামে এই রখম একটি ঘটনা সামাল দিয়ে এসে সুনামগঞ্জ আসার পরই একজন ডিএসবি খবর দিল আমার শালকরা নাকি ষোলঘর কোথায় পুলিশকে মারধোর করেছে ৷ শহর থমথমে ৷

আমি মনে মনে ভাবলাম ওরা আমাকে আজ গ্রেফতার করতে পারে ৷গ্রেফতার এরিয়ে চলতে আমার প্রতি নির্দেশ ছিল ৷আমি পারতপক্ষে রিকসায় দিনে চলাফেরা করতাম না ৷রাতে মোটর সাইকেলে চলতাম ৷বাসায় ঘুমাতাম না ৷ষোলঘর থেকে বাসার পর বাসা পেরিয়ে একেবারে আরফিন নগর তেঘরিয়া বড়পাড়া পর্যন্ত হেটে আসতাম ৷ ১৯৮৫ সালের আগে সাতবার আমি পুলিশ ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসি ৷আমি রাতে বাসায় খেতে আসলে আমার বড়কুটুমরা রাস্তায় পাহাড়া দিত ৷যোলঘর রাস্তা পর্যন্ত ২/৩ জন মিলে পুলিশের গাড়ী আসছে কিনা “ শব্দ বিনিময় পদ্ধতিতে “আমার কাছে খবর আসতো ৷তখন তো এখনকার মত মবাইল ছিলনা ৷আমি তখন খাওয়া ফেলে পেছনের মাঠ ৷(এখন বাসা বাড়ী) দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতাম ৷ দিনে ছাত্রনেতাদের নিয়ে জনাব আব্দুজজহুর সাহেবের বাসায় আড্ডা দিতাম ৷দুপুরের খাওয়া হতো ৷পরবর্তী করনীয় ঠিক করতাম ৷ জনাব জহুর সাহেবের বাসা থেকে পালাবার অনেক পথ ছিল ৷ ২বার জহুর সাহেবের বাসায় পুলিশ হানা দিয়ে কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি ৷

আমাদের মিলিত হওয়ার নিরাপদ জায়গা ছিল জনাব দেওয়ান উবায়দুররেজা সাহেবের বাসা ৷ওখানে পুলিশ হানা দিত না ৷একটা সময়ে পুলিশ মিছিল নিয়ে রাস্তায়ই উঠতে দিতনা ৷ ছাত্ররা তখন ছোট ছোট বল্ডার জোগাড় করে ৷একদিন বাসষ্টন্ড এ পুলিশের সাথে একটা খন্ড যুদ্ধ করে ফেলে ৷বল্ডারের শত শত খন্ড পুলিশের উপড় পড়তে থাকতো ৷পুলিশ ঐ দিন পিছিয়ে যায় ৷আমাদেরর পক্ষের কার যেন পা ভেঙ্গে যায় ৷সম্ভতঃ নাম বাবুল ৷ তারপর থেকেই ছাত্রদের মিছিলে হামলা পুলিশ এরিয়ে যেত ৷ক্রমান্নয়ে আমাদের মিছিল বড় হতে থাকলো ৷রাজপথ মিছিলের দখলে চলে আসলো ৷একএকটা মিছিল ষোলঘর পয়েন্ট থেকে বাজার পয়েন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত হতো ৷

১৯৮৫ সালের মে জুনের ঐ দিনেও আমরা জনাব আব্দুজহুরের বাসায় মিলিত হলাম ৷ আবু সুফিয়ান বললো এইবার আপনি গ্রফতার হবেন ৷আমিও শহরের থমথমে ভাব লক্ষ্য করলাম ৷কিন্তু গ্রেফতার এড়াবার কোন তাড়া মন থেকে পেলাম না ৷১৯৬৪ সাল থেকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুর মানুষ আমি কিন্তু জেল জীবন দেখিনি ৷ রাত সাড়ে ১১টায় ষোলঘরের একটি ছেলে অকারনে আমার বাসায় আসলো ৷ওকে আমি পুলিশের স্পাই হিসেবে জানতাম ৷তারপরও বাসায় ঘুমিয়ে পড়লাম ৷রাত ৩টার দিকে একজন লোক নজির ভাই নজিরভাই বলে ডাকতে শুনলাম ৷আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল ৷আমি জিজ্ঞেস করলাম কে ?বললো বাপ্টু ৷তখন ছাত্র আন্দোলনের মিলিটেন্ট কর্মী ৷পুলিশের খাতায় শীর্ষ আন্দোলনকারীদের তালিকায় নাম ৷আমি ওদের বিশ্বাস করতাম ৷আমি প্রতারিত হলাম ৷দরজা খুলে দিলাম ৷থানার ওসি খপ করে লুঙ্গির মুঠিটা আকড়ে ধরলো ৷চার দিকে শতশত পুলিশ ৷আমি বললাম একটু শার্টা গায়ে দিই ৷ঐ সময় আমার সহধর্মীনি সালমা আক্তার জেগে উঠেছেন ৷উনি সার্টটা এগিয়ে দিলেন ৷সার্টটি হাতে নিয়েই পুলিশের গাড়ীতে উঠলাম ৷কেউ নাই আমি একা ৷মনটাতে কিছু শান্তি এলো ৷কাউকে আর গ্রেফতার করেনি ৷আসলে ওরা আগে আমাকেই পিক করে ৷ উকিলপাড়া এসে বাপ্টুকে নিয়ে আসলো ৷পরে ওদের গাড়ী বাসষ্টেন্ডে আরপিন নগরের রাস্তার সামনে দাড় করিয়ে রাখলো ৷১৫/২০ মিনিট পর আবুসুফিয়ানকে নিয়ে আসলো ৷আমার একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল ৷সুফিয়ানের অট্রহাসিতে তন্দ্রা ভাংগলু ৷ বললাম হাসছো যে ৷ বললো আসল গুলো ধরা পড়েছে ৷ বললো আপনার সাথে জেলে যাচ্ছি ভারী মজা হবে ৷ সত্যি তার কান্ড কারখানা জেল জীবনটা উপভোগ্য করে তুলেছিল ৷

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn