ফয়সল আহমদ রুহেল : মো. ছায়ফুজ্জামান। এই মানুষটি ৪০ বছর কর্মময় জীবনে সুনামগঞ্জ জেলার দুই উপজেলায় বিলিয়েছেন শিক্ষার আলো। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন সততা আর নিষ্ঠার প্রতিচ্ছবি। শিক্ষাজীবনে থেকেছেন লজিং। লজিংয়ে যে কত কষ্টকর তা তিনি আজও ভুলেননি। লজিং থেকে যখন বাড়ি যেতেন ৮ মাইল রাস্তার মধ্যে অর্ধেক রাস্তাই তিনি কেঁদে কেঁদে যেতেন। মো. ছায়ফুজ্জামান সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার বীরগাঁও এমদাদুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।

জন্ম : মো. ছায়ফুজ্জামান ১৯৫৬ সালের ১০ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার বীরগাঁও বাজারের উমেদনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. লোকমান উল্লা, মাতা মোছা. কমরুন নেছা বেগম। পাঁচ ভাই ও দুই বোন এর মধ্যে তিনি চতুর্থ ।বর্তমানে তিনি সুনামগঞ্জ বনানীপাড়ায় বসবাস করেন।

শৈশবের স্মৃতি : মো. ছায়ফুজ্জামান তিন বোনের পরে ভাই হওয়ায় পরিবারের খুব আদরের ছিলেন। তিনি ছিলেন ভীরু স্বভাবের। সে কারণে শিক্ষকদের খুব ভয় পেতেন পাশাপাশি শ্রদ্ধা করতেন। মো. ছায়ফুজ্জামান যখন সফাত উল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন তখন লজিংয়ে থাকতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে চলে আসতেন এবং শনিবার লজিংয়ে চলে আসতেন। লজিংয়ে যে  কত কষ্টকর তা তিনি আজও ভুলেননি। ৮ মাইল রাস্তার মধ্যে অর্ধেক রাস্তাই তিনি কেঁদে কেঁদে যেতেন। সফাত উল্লা উচ্চ বিদ্যালয় ছিল জগদীশপুর গ্রামে। ঐ গ্রামেই তিনি লজিং থাকতেন। মো. ছায়ফুজ্জামান আপন ফুফুর ঘরে লজিং ছিল। তখনকার সময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। মো. ছায়ফুজ্জামানের পরিবারের কেউ মেনি মাছ দিয়ে তরকারী খেতেন না। কিন্তু তাঁর ফুফু মেনি মাছ দিয়ে তরকারী রান্না করে ভাত খাওয়ার জন্য বললে তিনি বলে দেন, আমি তোমার ঘরে লজিং থাকব না। কারন তোমরা মেনি মাছ দিয়ে তরকারী খাও। মেনি মাছ- হলো ভেঁদা মাছ।

শিক্ষাজীবন : মো. ছায়ফুজ্জামান নিজ গ্রাম উমেদনগর প্রা. বিদ্যালয়ে ১৯৬৬ ইং সনে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার জগদীশপুর সফাত উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯৭২ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাশ করেন।  ১৯৭৪ সালে

মদন মোহন কলেজ, সিলেট থেকে এইচএসসি (বাণিজ্য) ২য় বিভাগে পাশ করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৭৬ ইং সনে ৩য় শ্রেণী পেয়ে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক পাশ করেন। ১৯৯০ইং সনে কুমিল্লা টি.টি কলেজ থেকে উচ্চতর ২য় শ্রেণী পেয়ে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মকাল : মো. ছায়ফুজ্জামান স্যার জগন্নাথপুর উপজেলার জগদীশপুর সফাত উল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে ১৯৮২ ইং হতে ১৯৮৬ ইং পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। এরপর সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার বীরগাঁও ইমদাদুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৯৮৭ ইং হতে ১৯৯০ ইং এরপর সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন ১৯৯১ ইং পর্যন্ত। একই বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক ১৯৯২ ইং থেকে ২০০০ ইং পর্যন্ত। সর্বশেষ প্রধান শিক্ষক ২০০১ ইং থেকে ২০১৬ ইং পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতার পর তিনি  ২০১৬ ইং সনের ১১ ডিসেম্বর অবসরে চলে যান। অবসরে চলে যাওয়ার পর তিনি চাইল্ড কেয়ার একাডেমি নামে একটি কেজি স্কুলে ২০১৮ ইং হতে এপ্রিল ২০২২ ইং পর্যন্ত প্রিন্সিপাল ছিলেন।

সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. ছায়ফুজ্জামান সিলেট বিভাগীয় আহ্বায়ক কমিটির (বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি) সদস্য, শান্তিগঞ্জ উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সুনামগঞ্জ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সিনিয়র সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

কর্মকালীন অভিজ্ঞতা : মো. ছায়ফুজ্জামান ২০০৮ ইং হতে ২০১৫ ইং পর্যন্ত সিলেট বিভাগের এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজী বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন : ১৯৭৮ ইং সনে করাচিতে, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বাসা পরিদর্শন, পঞ্চগড়ের অমৃত-স্বর্ণ মন্দির পরিদর্শন, একই বছর লাহোর ভ্রমন। ১৯৭৯ সালে ইরানের বন্দর আব্বাস কোস শহর ইস্পাহান জায়েদান শহর ভ্রমন। ১৯৮১ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বম্বে ভ্রমন করেন।

বাংলাদেশের শিমুল বাগান (সুনামগঞ্জ), জাফলং (সিলেট), গোলাপগঞ্জের ড্রিমল্যান্ড, মাধবকুন্ড, চা গবেষণা কেন্দ্র শ্রীমঙ্গল। কুমিল্লা, ময়নামতি শালবন বিহার। বান্দরবনের নিলগীরি দর্শনীয়। ঢাকার দর্শনীয় স্থান সমূহ, পতেঙ্গা সিবীচ, ইনানী সী বীচ, হিমছড়া ইত্যাদি।

পারিবারিক : পারিবারিক জীবনে মো. ছায়ফুজ্জামান দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক। বড় মেয়ে বাংলা অনার্স (সম্মান) পাস করার পর বিয়ে দেন। ছেলে ছোটখাট ব্যবসা করে ও বিবাহিত। ছেলের বউ সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে বিএসসি নার্সিং এ পড়ে। ছোট মেয়ে অনার্স (সম্মান) পড়া অবস্থায় সিলেটে একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কলার্স হোম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি করেন। চার বছর চাকরী করে অনার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে মাস্টার্সের জন্য লন্ডনে আছেন।

২০২৩ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায়  শান্তিগঞ্জ উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।

সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ২৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।

উল্লেখ্য, ২৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।

শ্রদ্ধেয় মো. ছায়ফুজ্জামান শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছেন, শিখতে উৎসাহ দিয়েছেন। আত্মবিশ্বাস উন্নত করেছেন, গর্বিত হতে শিখিয়েছেন। তাই ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সবাই তাঁর কৃতিত্বে কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত ছিলেন। কথাবার্তায়, চালচলনে তিনি সাদাসিধে মানুষ; একজন সাদা মনের মানুষ। আমরা তাঁর দীর্ঘায়ূ ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn