ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় যেতে যোগাযোগ ব্যবস্থার কাঠামোর জন্য কী যে দুর্গতি পোহাতে হয়, তা ভুক্তভোগীরাই কেবল জানি। তবে অনেক দিন আগে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেল লাইনের খবরটি আমাদের আলোড়িত করেছিল। আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম। পত্রিকা ঘেঁটে জেনেছি, সুনামগঞ্জ জেলা শহরকে রেল যোগাযোগের আওতায় আনার দাবি উঠেছিল সেই ১৯৬১ সালে। সুনামগঞ্জের সবজী, পাথর ও মাছ কম খরচে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছানো এবং একমাত্র সড়কের বিকল্প একটি রেলওয়ে লাইন চালুর দাবি হাওরবাসীর দীর্ঘদিনের। জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জ শহরের হাসননগরের বাসিন্দা তৎকালীন সিলেট ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের সদস্য রাবেয়া লেইছ ১৯৬১ সালে প্রথম ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের সভায় এই দাবি তুলেছিলেন। এরপর ২০১১ সালে সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সেক্রেটারী ও পরে সভাপতি অ্যাড. রবিউল লেইস রোকেস জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটি স্মারকলিপিও প্রদান করেছিলেন। আরও কয়েক বছর পর ২০১৬ সালে সুনামগঞ্জ-১ (জামালগঞ্জ-ধর্মপাশা-তাহিরপুর) আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন মোহনগঞ্জ থেকে ধর্মপাশা-মহেষখলা-টেকেরঘাট-লাউড়েরগড় হয়ে সুনামগঞ্জ শহরতলির বৈঠখালি ঘাট পর্যন্ত রেললাইন বর্ধিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন জানিয়ে ছিলেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই চিঠি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে পাঠিয়ে বলা হয়েছিল প্রকল্পটি ডিপিপিভুক্ত করার জন্য। এমনকি ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জে রেললাইন স্থাপন নিয়ে জাতীয় সংসদে কথা বলেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। সেদিনের সংসদ অধিবেশনে স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সন্ধ্যার পর পীর মিসবাহ রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হককে একটি সম্পূরক প্রশ্ন করেছিলেন। পীর মিসবাহ সম্পূরক প্রশ্নে বলেছিলেন, সুনামগঞ্জের ছাতকে বহু আগে থেকেই রেললাইন আছে। জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি থাকার পরও এটি জেলা সদরে সম্প্রসারণ করা হয়নি।

সুনামগঞ্জের সন্তান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলপথ মন্ত্রী হবার পর রেললাইন সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিলেও পরে এটি আর আলোর মুখ দেখেনি। তিনি মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন,‘ছাতকের রেললাইনটি দোয়ারাবাজার উপজেলা হয়ে জেলা সদরে সম্প্রসারণ করা যাবে কিনা। জবাবে মন্ত্রী মুজিবুল হক পীর মিসবাহকে ডিও লেটারসহ সাক্ষাৎ করতে বলেছিলেন। ডিও লেটার পাবার পর তিনি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন বলে জানান। ২০১৬ সালের ২৭ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের বাজেট বক্তব্যকালে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক-সুনামগঞ্জ-মোহনগঞ্জ রেললাইন স্থাপনের দাবি জানিয়েছিলেন সুনামগঞ্জ -৫ (ছাতক-দোয়ারা) আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক। তিনি লেলমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেদিন বলেছিলেন,‘ ছাতক পর্যন্ত রেল লাইন চালু রয়েছে। তাই ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ জেলা শহর পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপন সহজ উল্লেখ করে তিনি ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণের দাবি জানান। এছাড়া ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের জন্য জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় প্রস্তাব করেন সে সময়ের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল। রাজধানীতে ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই থেকে শুরু হওয়ায় চার দিনব্যাপি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে জেলা প্রশাসক ওই রেলপথ সম্প্রসারণের জন্য রেলমন্ত্রী ও রেল সচিবের কাছে ডিও লেটার তোলে দেন। ওই সম্মেলনে বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও রেলপথ সম্প্রসারণের দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। আসলে ছাতক থেকে আমাদের জেলা শহর পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের দাবি দীর্ঘদিনের। জেলার সকল শ্রেণী পেশার লোকজন এই দাবির সাথে একমত। সুনামগঞ্জ শহর পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হলে সহজে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ স্থাপন ও পণ্য পরিবহণ করা সম্ভব হবে। এতে আমাদের সময় বাঁচবে এবং অর্থের অপচয় রোধ হবে। তবে এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য নানাভাবে উদ্যোগ নেয়া হলেও আলোর মুখ দেখছে না। সুনামগঞ্জবাসীর প্রাণের এই দাবি যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা হোক। মাত্র ২৭ কিলোমিটার রেললাইন সম্প্রসারণ করলে ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপন হয়ে যাবে। ছাতক থেকে রেললাইন বর্ধিত করে সুনামগঞ্জের মাইজবাড়ী-বদিপুর এলাকায় স্টেশন করা কঠিন কোন কাজ নয়।

সুনামগঞ্জ জেলা সদরে রেললাইন সম্প্রসারণের দাবিটি স্বপ্নের জগৎ ছাড়িয়ে বাস্তবতার দিকে যাত্রা শুরু করবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। রেল মন্ত্রণালয় জেলা সদর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য সরকারের নিকট প্রতিবেদন দাখিল করেছিল। প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ৭ কোটি ৫৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ৩০ জুন ২০১৮ তারিখের মধ্যে এই সমীক্ষা শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রস্তাব সরকার অনুমোদন করলে এই কাজ নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে (১ জানুয়ারি ২০১৭ থেকে) শুরু করা হবে আশা করেছিলাম সবাই।

জেনেছি, সুনামগঞ্জ জেলার সামাজিক, প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক বিস্তৃত ইতিহাস ও বিবরণ জানিয়ে এখানে রেললাইন সম্প্রসারণ অর্থনীতি ও জনসেবার আলোকে প্রয়োজনীয় উল্লেখ করে রেল মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনায় সুপারিশ করা হয়েছিল। সেই প্রস্তাবনায় ছাতক থেকে আন্ধারীগাঁও, আন্ধারীগাঁও থেকে শিবপুর, শিবপুর থেকে শ্রীপুর, শ্রীপুর থেকে রেঞ্জের বাজার এবং রেঞ্জের বাজার থেকে সুনামগঞ্জ সদর পর্যন্ত ৫টি সেকশন নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া জেলা সদরের পাঠানবাড়ী-হাসননগর এলাকায় রেলস্টেশন স্থাপনের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখিত পথে রেললাইনের দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার বলে প্রাথমিকভাবে স্থির করা হয়েছে। সমীক্ষায় রেললাইনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ও ক্ষতিপূরণ পদ্ধতি নির্ণয়সহ এর জন্য কত টাকা খরচ হবে তার সুপারিশ ওঠে আসবে। অর্থাৎ ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার রেললাইন সম্প্রসারণে সর্বমোট কত টাকা খরচ হবে তার একটি বিস্তারিত প্রাক্কলন তৈরি করা হবে সমীক্ষা প্রতিবেদনে।

আমার গ্রামের বাড়ি ধর্মপাশা উপজেলায়। আর হাওরাঞ্চলের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার মানুষকে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়, এ কথা কে না জানে। তাই ধর্মপাশা উপজেলাসহ হাওরাঞ্চলের মানুষ প্রতিদিন তাদের প্রয়োজনে মোহনগঞ্জ হয়ে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় রেলপথে যাতায়াত করেন। এ জনপদের মানুষের সহজ যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের লক্ষ্যে ১৯১৯ সালে নেত্রকোনার ৭২ কিলোমিটার রেলপথ তৈরি করা হয়েছিল। এর একটি ৫৫ কিলোমিটার দূরত্বের গৌরীপুর-নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ রেলপথ। অপরটি হলো ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ শ্যামগঞ্জ-জারিয়া রেলপথ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মোহনগঞ্জ-ঢাকা রুটে ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই ‘হাওর এক্সপ্রেস’ নামের একটি আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রা শুরু হলেও হাওরাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ধর্মপাশা পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে যায়। ফলে ধর্মপাশা উপজেলাসহ হাওরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষকে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রয়োজনে ৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মোহনগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছতে গিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তবে মোহনগঞ্জ-নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ-ঢাকা রেলপথে বহুল প্রত্যাশিত আন্তঃনগর ট্রেন ‘হাওর এক্সপ্রেস’ চালু হওয়ায় একদিকে যেমন নেত্রকোনাবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, অন্যদিকে সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত ধর্মপাশা (মধ্যনগর)-তাহিরপুর উপজেলাবাসীর রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সহজতর যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও ব্যবসাবাণিজ্যে উন্নয়নের ধারা সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মপাশায় রেলস্টেশন স্থাপনের জন্য ১৯৮১ সালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিন্তু পরে তা আর হয়ে ওঠেনি। মোহনগঞ্জ থেকে ধর্মপাশা আর ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত এই দুটি রেললাইন সম্প্রসারণ করা হলে হাওরাঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি পূরণ হবে। আর এ দাবি পূরণ হলে হাওরাঞ্চলের প্রতিটি মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, তাদের যোগাযোগ হবে অনেকটা সহজ ও সাধ্যের মধ্যে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn