সুনামগঞ্জঃ ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সুনামগঞ্জের সব হাওরের বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা। তবে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলার কোথাও বাঁধ নির্মান কাজ শুরু করা যায়নি। এই বিলম্বের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা প্রশাসন একে অপরকে দোষারূপ করেছে। দুই প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতার কারণে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।  পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-এর কর্মকর্তারা বলছেন, উপজেলা প্রশাসন এখন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করতে পারেনি তাই বাঁধের কাজ শুরুতে দেরী হচ্ছে। আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা বলছেন, পাউবো কর্মকর্তারা এখনো প্রকল্প নির্ধারণ ও প্রক্কলন করতে পারেননি। ফলে কাজ শুরুতে বিলম্ব। তবে দুই পক্ষই হাওড়ের পানি ধীর গতিতে নামাকেও নির্মাণ কাজের বিলম্বেও জন্য দায়ী করছেন।
গত মৌসুমেও নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মান কাজ শুরু হয়নি। তখন নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি অনেক বাঁধের কাজ। ফলে মার্চ-এপ্রিলের অকাল বন্যায় হাওরে পানি ঢুকেত ভাসিয়ে নিয়ে যায় বিস্তৃর্ণ বোরো ফসল। সরকারী হিসেবে, ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওরের ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষকদের হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ ছিল। এ মৌসুমেও নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু না হওয়ায় আগামী বোরো ফসল নিয়ে শঙ্কায় ভ’গছেন কৃষক। পাউবো সূত্রে জানা যায়, ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে হাওরের বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা। আর ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।
অন্যান্য বছর ঠিকাদারদের মাধ্যমে পাউবো হাওরের বাঁধ নির্মাণ করতো। তবে গত মৌসুমের ফসলহানির পর পাউবো কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। এনিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে বাঁধ নির্মানে ঠিকাদারী প্রথা বাতিল করে পানিসম্পদ মন্ত্রনালয়। ঠিকাদারদের বদলে এবার হাওরের সব বাঁধের কাজ করবে স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে গঠিত পিআইসি। কৃষকদের পাশাপাশি এবার বাঁধের কাজে সরাসরি প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে জেলা ও উপজেলা কমিটি। উপজেলা কমিটিই পিআইসি গঠন ও প্রকল্প নির্ধারণ করবে। পিআইসিতে ইউএনও আহ্বায়ক ও পাউবো কর্মকর্তা সদস্য সচিব হিসেবে থাকবেন। পাউবো’র সুনামগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবার সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলার ৩৬টি বৃহৎ হাওড় ও ১৭টি উপ প্রকল্পসহ মোট ৫৩ টি হাওরে সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এজন্য মোট ১ হাজার ৮৮টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রকল্পের সমপরিমান পিআইসি গঠন করা হবে। প্রতিটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫  লাখ টাকার কাজ করবে। বাঁধ নির্মাণের জন্য ৬০ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। তবে কাজের জন্য আরও প্রায় ৬৫ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড, সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভ’ঁইয়া বলেন, উপজেলা প্রশাসন এখন পর্যন্ত পিআইসি গঠন করতে পারেনি। বাঁধের কাজ শুরু করবো কি করে। তিনি বলেন, তারা পিআইসি গঠন করে ফেলেছে বলে শুনেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত  আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কাগজ পাইনি। তিনি বলেন, তারা (উপজেলা কমিটি) এই কাজগুলো করার উপযুক্ত কী না এই নিয়েই আমি সন্দিহান। আমরা সবধরণের সহযোগিতা করার পরও তারা যদি কাজটা শুরু করতে পারছে না। আমার মনে হচ্ছে উপজেলা পর্যায়ের যে ১২ সদস্যের কমিটি করা হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই অদক্ষ। তবে এমন বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন ইকবাল বলেন, আমার এখানে পিআইসি গঠন প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু প্রাক্কলনের জন্য এখন পর্যন্ত পাউবো’র কোনো কর্মকর্তা আমার এলাকায় আসেননি। এছাড়া হাওরের পানিও এখন পর্যন্ত নামেনি। ফলে কিছুটা দেরী হচ্ছে।
জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ বলেন, আমার উপজেলায় ১০২ টি পিাইসি গঠন করা হবে। এর বেশিরভাগই গঠন হয়ে গেছে। কিন্তু পাউবো’র লোকবল সঙ্কট থাকায় প্রকল্প নির্ধারণ ও প্রাক্কলনে বিলম্ব হচ্ছে। জামালগঞ্জের ইউএনও শামীম আল ইমরান বলেন, পিআইসি গঠন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু হাওরের পানি না নামার কারণে পাউবো প্রাক্কলন করতে পারছে না। এজন্য কাজ শুরুতে দেরী হচ্ছে। তবে আশা করছি, জানুয়ারির শুরুর দিকে কাজ শুরু করতে পারবো। এবং কাজ শুরু হয়ে গেলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বাঁধ নির্মাণ শেষ করা যাবে। ছাতকের ইউএনও মোহাম্মদ নাছির উল্লাহ খান বলেন, ছাতকের পাউবো কর্মকর্তা অসুস্থতাজনিত ছুটিতে রয়েছেন। ফলে কাজ একটু পিছিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জের বোরো জমির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর। গত বছর বোরো জমি চাষাবাদ করা হয়েছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫ হেক্টর। কৃষকরা প্রত্যাশা করেছিলেন, গতমৌসুমের ফসলহানির পর ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার প্রেক্ষিতে এবার সঠিক সময়েই বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হবে। তবে এবারও নির্ধারিত সময়ের ১৫দিন পেরিয়ে গেলেও কাজ শুরু না হওয়ায় ক্ষুব্দ তারা। এ ব্যাপারে হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সাবেক সদস্য সচিব বিন্দু তালুকদার বলেন, গত মৌসুমের ফসলহানির পর এতো সমালোচনা-তোড়জড়ের পরও যদি এবার নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হয় না হয় তারচেয়ে দূর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে। সংশ্লিস্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণেই বাঁধ নির্মাণ কাজে বিলম্ব হচ্ছে। তাছড়া প্রকৃতিও কিছুটা বিরুদ্ধাচারণ করছে। অনেক হাওর থেকে এখনও পানি নামেনি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn