নির্ধারিত সময়ে একটি বাঁধেরও কাজ শেষ হয়নি।
কৃষকের আড়ালে কাজে যুক্ত হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা।
খলিল রহমান-
সুনামগঞ্জের হাওরে ফসলহানি আর কৃষকের হাহাকারের পর বছরজুড়ে এত আলোচনা-পরিকল্পনার পরও নির্ধারিত সময়ে একটি বাঁধেরও কাজ শেষ হলো না। গত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু কাজ হয়েছে গড়ে ৬৫ ভাগ। ৫০টি হাওরে এখন ৯৬৪টি বাঁধ প্রকল্পের কাজ চলছে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, হাওরের প্রকৃত কৃষক এবং হাওরে যাঁদের জমি আছে, তাঁদের সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) করে এসব কাজ করার কথা। কিন্তু সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসব কমিটিতে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ঢুকে পড়েছেন। নামে-বেনামে বাঁধের কাজে যুক্ত হয়ে গাফিলতি করছেন।‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের সভাপতি বজলুল মজিদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন, আমরা হতাশ। এত কথা, এত চিৎকার করলাম। তবু সময়মতো কাজ শেষ হলো না। এটা হাওরবাসীর জন্য খুবই দুঃখজনক। কৃষকদের মধ্যে এখনই ফসল নিয়ে আতঙ্ক শুরু হয়ে গেছে।’জেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলায় গত মৌসুমে বোরো আবাদ হয়েছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৮ হেক্টর। গত বছরের এপ্রিলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪টি হাওরের বোরো ধান তলিয়ে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জেলার ৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯০টি কৃষক পরিবার। প্রধান ফসল হারিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ নিঃস্ব হয়ে যান।জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফিরোজ খান জানিয়েছেন, এ মৌসুমে ২ লাখ ২১ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে।জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এবার সুনামগঞ্জের ৫০টি হাওরে ফসল রক্ষায় বাঁধের কাজ হচ্ছে। এ জন্য গঠন করা হয়েছে ৯৬৪টি পিআইসি। প্রতিটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ করতে পারে। এ কাজে এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২২ কোটি টাকা। অতীতে বাঁধের কাজে কখনো এত বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। গত বছর এ বরাদ্দ ছিল ৬৮ কোটি টাকা।

কেন বিলম্ব
কাজের প্রকল্প নির্ধারণ ও প্রাক্কলন তৈরিতে বিলম্ব হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা ছিল। এ কারণে পিআইসি গঠনেও বিলম্ব হয়েছে। এ ছাড়া কাজে গাফিলতি করছেন পিআইসির সদস্যরা।সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের বৈশাখী এলাকার বাঁধ ভেঙে গত বছর ফসলহানি ঘটে। ওই বাঁধের কাজ করেছিলেন দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নূরে আলম চৌধুরী। এবারও এ বাঁধ নির্মাণে গঠিত কমিটির তিনিই সভাপতি। তিনি একা নন, তাঁর দুই চাচা আলাউদ্দিন চৌধুরী ও আফতাব উদ্দিন চৌধুরী, চাচাতো ভাই রিপন চৌধুরীও অন্য তিনটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত।একইভাবে উপজেলার বরাম হাওরের স্থানীয় তাড়ল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আহমদ চৌধুরীর ভাই আমিনুর রহমান চৌধুরী ও আবিদুর রহমান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের নেতা মতছির মিয়া চৌধুরী, আবদুস সালাম, উদগল হাওরে স্থানীয় সরমঙ্গল ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি দুলাল মিয়া বাঁধের কাজে যুক্ত।শাল্লা উপজেলায় চারটি ইউনিয়ন। এখানে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা ছয়জনই বাঁধের কাজে যুক্ত। তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর খোকন ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি হাফিজ উদ্দিন, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক বোরহান উদ্দিন, উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম নাসেরও বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

সাংসদদের ভূমিকা
নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের কাজের উপদেষ্টা হলেন স্থানীয় সাংসদেরা। বিভিন্ন উপজেলায় সাংসদের লোকেরাই পিআইসিতে রয়েছেন। তাঁরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। দলীয় প্রভাব খাটাচ্ছেন।সুনামগঞ্জ-১ আসনের (তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধরমপাশা) ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, কাজের অগ্রগতি অন্য বছরের তুলনায় ভালো। তবে নানা কারণে এবার কাজ শুরু হয়েছে দেরিতে। তাই কিছুটা সময় বেশি লাগবেই। কাজে পাউবো ও স্থানীয় প্রশাসনের কিছুটা সমন্বয়হীনতা রয়েছে। দলীয় লোকজনের প্রভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই হাওর রক্ষায় নেমেছি। খোঁজ নিয়ে দেখেন, বিএনপির লোকজনও কাজ করাচ্ছে।’সুনামগঞ্জ-৪ আসনের (সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর) জাতীয় পার্টির সাংসদ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, ‘আমি বাঁধের বিষয়ে কিছু জানি না। আমাকে কেউ কখনো ডাকেওনি। বাঁধের কাজের দায়িত্ব পাউবো ও প্রশাসনের। কোনো কারণে ফসলের ক্ষতি হলে তাদেরই জবাবদিহি করতে হবে।’সুনামগঞ্জ-৩ আসনের (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও জগন্নাথপুর) সাংসদ অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেছেন, এবার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে পাউবো। হাওর থেকে এবার পানি ধীরে নামায় প্রথম দিকে পাউবোর লোকবল কম থাকায় প্রকল্প নির্ধারণ ও প্রাক্কলন তৈরিতে সময় একটু বেশি লেগেছে। তাই সময়মতো কাজ শুরু করা যায়নি। তিনি মনে করেন, এবার কাজ ভালো হচ্ছে। পুরো কাজ শেষ হতে আরও সপ্তাহখানেক লাগবে।

তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের মারালা গ্রামের কৃষক আজিরউদ্দিন বলেন, ‘দিন তো যার গি। কাজ ত শেষ অইল না। এখন ত যেকোনো দিন বৃষ্টি শুরু অইব, ঢল আইব। আর ঢল আইলে ত ধান শেষ’।

সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, আগে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ হতো ঠিকাদার ও পিআইসির মাধ্যমে। গত বছর হাওরে ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ ওঠায় নতুন নীতিমালা করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রথা। কাজে সরাসরি যুক্ত করা হয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে।

শাল্লা উপজেলায় কাজের অগ্রগতি সবচেয়ে কম, মাত্র ৫০ ভাগ। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গনেন্দ্র চন্দ্র সরকার বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করবেন কৃষক। কিন্তু কৃষকেরা তো সামনে, পেছনে আছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। কিছু কাজ আছে দুই দিন আগে মাত্র শুরু হয়েছে। কাজ চলছে। কবে শেষ হবে বলা যাবে না।

দিরাইয়ের ইউএনও মঈন উদ্দিন ইকবাল বলেন, তাঁর উপজেলায় ১৩০টি প্রকল্পে কাজ হচ্ছে। কোনো কাজই এখনো শেষ হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ চার-পাঁচটি প্রকল্পের কাজ ৯০ ভাগ শেষ হয়েছে।

সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, তাঁরা দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। বাঁধের কাজ শেষ হতে আরও দুই সপ্তাহ লাগতে পারে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn