গরু নিয়ে কাঁদছে কৃষক
তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরের পূর্ব-দক্ষিণপাড়ের কিষানি জবা রাণী তালুকদার (৪২)। হাওরটির দিকে তাকিয়ে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে জোড় হাত করে প্রণাম করলেন। গন্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া দুই ফোঁটা অশ্রু শাড়ির আঁচলে মুছলেন। নিজ বাড়ির গোয়ালঘরের সামনে দাঁড়ানো মেয়ে জুঁই ও ছেলে অনুকুলের চোখেও জল। গোয়ালের ভেতর ঢুকে দেখা যায় জবা রাণীর স্বামী জ্যোতিষ তালুকদার গরুর গলায় বাঁধা রশি ধরে গরুটির দিকে চেয়ে কাঁদছেন। বাড়ির গোয়ালে বাঁধা ৫টি গরু। সবাই এ গরুগুলোর দিকে তাকিয়ে কাঁদছে কেন ? জানতে চাইলে জবা রাণী জানান, গেল বছর হাওরটিতে ২০ কিয়ার (১কিয়ার=৩০ শতক) জমি করেছিলেন। শিলাবৃষ্টিতে তার সবটুকু জমির ধানই নষ্ট হয়েছিল। এ বছর হাওরের ১৫ কিয়ার জমিতে আবারও ধানের চাষ করেছেন। কিন্তু সবটুকু জমির কাঁচা ধানই গলা সমান পানিতে তলিয়ে গেছে। এ জমিগুলোতে ধানের চাষ করতে আর সংসারের আর্থিক খরচ মেটাতে ৬মাস আগেই ৫টি গরু বিক্রি করেছেন। এখন গোয়ালে থাকা বাকী গরু কিনতে পাইকার (গরুর ক্রেতা) বাড়ি এসেছে। ঘরে নিজেদের খাবার নেই, যোগাড় হয়নি গরুর খড়ও । ঋণও আছে কিছু টাকা। তাই নিজের চেয়েও বেশী যন্তে রাখা গরুগুলো অর্ধেক দামে বিক্রি করছেন।
নয়তো নিজের সঙ্গে উপোস থাকবে গরুও। তাই বাড়ির উঠোনে প্রিয় গরুর ক্রেতা দেখে কেউই চোখের জল ধরে রাখতে পারছেন না। গতকাল শুক্রবার জামলাবাজ গ্রামে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। জবা রাণী বলেন, আমার স্বামী কিছুটা অসুস্থ। অভাবের সংসারে বহু কষ্ট করে ছেলেমেয় নিয়ে দশটা গরু করেছিলাম। হাওরের ধান আর গোয়ালের গরু হারিয়ে আমার পরিবার এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুস সালমা বলেন, গত মঙ্গলবার গভীর রাতে মাটিয়ান হাওরের আলমখালি বাঁধটি ভেঙ্গে যায়। এতে করে হাওরটিতে চাষ করা ৩হাজার ২শ হেক্টর জমির কাঁচা ধান সম্পূর্ণ রুপে পানিতে তলিয়ে যায়। তিনি জানান, উপজেলার ১৮ হাজার ৪শ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে তুলনামুলক নীচু হাওরাঞ্চলে ১৫ হাজার একশত হেক্টর জমিতো এ বছর বোরো ধানের চাষ হয়। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান পানিতে সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে গেছে। বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় গবাদিপশুর চরম খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। পানি এখন গ্রামের পাশে তাই গরুগুলোকে গোয়ালে রাখতে হবে। কিন্তু এ বছর গরুর কোন খড় কৃষকদের সংগ্রহে নেই।
উল্লেখ্য সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে বছরে একটিমাত্র ফসল বোরো ধানের চাষ করেন হাওরপাড়ের কৃষকরা। এই হাওরগুলো বছরের ৬মাস ৬ থেকে ১৫ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। সাধারণত অগ্রহায়ন থেকে হাওরের পানি কমতে শুরু করলে ধানের বীজতলা তৈরী শুরু হয়। যা পৌষ ও মাঘ মাসে হাওরের জমিতে রোপন করা হয়। আর বৈশাখ মাসে যখন ধান পাকে তখন ধান কাটা হয়। এই সময় বাঁধ বা বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে যদি পানি প্রবেশ করে। তবে (৮মাস পর) অগ্রহায়ণ মাস ছাড়া এ পানি কমার কোন সম্ভাবনা নেই। বর্ষায় হাওরের পানির উচ্চতা আরো বেড়ে যায়। এ সময় গ্রামগুলোর চারপাশ গভীর পানিতে বেষ্টিত থাকে। আমরা হাওরবাসী সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী রুহুল আমিন বলেন, হাওর থেকে উৎপাদিত বোরো ধান আর গোয়ালের গরু হাওরপাড়ের কৃষক পরিবারের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। কৃষকের ধান পানিতে তলিয়েছে এবার গো-খাদ্য সংকট আর পরিবারের আর্থিক অনটন তাড়াতে গোয়ালের গরু যাবে। লোভার হাওরপাড়ের রসুলপুর গ্রামের কৃষক শাহজাহান মিয়ার ৪টি গাভী রয়েছে । গাভীগুলো থেকে তিনি প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ কেজি দুধ পান। এক কেজি দুধ নিজের জন্য রেখে বাকীগুলো বাড়ি বাড়ি বয়ে বিক্রি করেন। মাটিয়ান ও লোভার হাওরে চাষকরা তার ১২ কিয়ার জমির কাঁচা ধানই পানিতে তলিয়ে গেছে। গরুর খড়ও সংগ্রহ করা যায়নি। তাই গোখাদ্য সংকট এবং পারিবারিক ব্যয় মেটাতে তিনি ৩টি গাভীই বিক্রি করে দিচ্ছেন।
তাহিরপুর উপজেলার বৃহৎ বাজার বাদাঘাট । এই বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আাপ্তাব উদ্দিন বলেন, হাওরডুবির পর থেকেই বাজারে গরুর কেনা বেচার সংখ্যা হঠাৎ করেই অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। দামও অনেক কমে গেছে। কৃষকরা বাধ্য হয়েই গরু কমদামে বিক্রি করছেন। তাহিরপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন বলেন, আগামি কয়েক বছর হাওরডুবির ঘটনা না ঘটলেও কৃষকদের এ আর্থিক ক্ষতি পোষাতে আর গোয়ালে গরু ভরতে এক যুগ লেগে যেতে পারে। মহালিয়া হাওরপাড়ের কৃষক সাহাবুদ্দিন বলেন, গরুর খেড় (খড়) নাই, নিজের ঘরও খাওন (খাবার) নাই। এল্লাইয়্যা (এজন্য) গরু বেইচ্ছা (বিক্রি করে) দিছি। রতনশ্রী গ্রামের কৃষক আজাদুর রহমান বলেন, কৃষকেরা গোয়ালের গরুকে নিজের সন্তানের মতোই আদর করে পালন করে। ধান গেছে পানিতে। এবার গরু হারানোর কষ্টে কৃষক পরিবারগুলো চোখের জল ফেলছে।
মাটিয়ান হাওর উন্নয়ন কমিটির সভাপতি আব্দুল জলিল তালুকদার বলেন, হাওরে উৎপাদিত নিজের জমির কাঁচা ধান চোখের সামনে তলিয়ে যাওয়া দেখে কেঁদেছে কৃষক। এবার গোয়ালে বসে নিজের গরুর দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের সদস্য সচিব বিন্দু তালুকদার বলেন, ধান গেলে মান যায়। হাওরবাসীর ঘরে ভাত নেই, তাগিদে আছে ঋণের জন্য। এখন কাঁদছে গোয়ালের গরু বেঁচে। আমরা এর জন্য দায়ীদের বিচার ও ক্ষতিগ্রস্থদের সার্বিক পুর্ণবাসন চাই। জেলা পরিষদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি আবুল হোসেন খান বলেন, গোখাদ্য সংকট আর পরিবারের আর্থিক চাহিদা মেটাতে চোখের জলে ভিজে গরু বিক্রি করছেন কৃষক।