‘মুছে যাক গ্লানি, মুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরাÑ’ সব গ্লানি ও ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে শুভ, কল্যাণ ও মঙ্গলের প্রত্যাশায় শুরু হলো নতুন বঙ্গাব্দ ১৪২৪। আজ পহেলা বৈশাখ। নতুন বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। বাঙালির সর্বজনীন লোকজ উৎসবে মেতে ওঠার সময়। আবহমান কাল থেকেই বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণসহ বারো মাস বাঙালির একান্ত নিজস্ব ছিল। বাংলাসহ ভারতীয় ভূখন্ডে শকাব্দ, লক্ষণাব্দ ইত্যাদি যে বর্ষপঞ্জি প্রচলিত ছিল তাতে এই মাসগুলোই ছিল। প্রতিটি মাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরাণ, কাব্যকাহিনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সনগুলো ছিল চান্দ্র-সৌরমিশ্র সন। ব্যাকরণ অনুযায়ী অগ্রহায়ণ মানে অগ্র+হায়ণ (বৎসর)। অর্থাৎ বছরের প্রথম। অগ্রহায়ণ মাসে সে সময় নতুন ফসলও উঠত। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে প্রাচীন বাংলায় হয়তো বছরের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ।

১২০১ সালে বখতিয়ার খিলজির বাংলাজয়ের পর বিভিন্ন অঞ্চলে হিজরি সনেরও প্রচলন শুরু হয়। বিশেষ করে দরবারের কাজকর্মে। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সুবা বাংলা নামে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে সময় পুরো সুবাতে খাজনা আদায়ের জন্য একটা সমন্বিত বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। সম্রাট আকবরের নির্দেশে আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি মলমাস বাদ দিয়ে সৌরবর্ষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করেন। মূলত হিজরি সনকে ফসলি সনে রূপান্তর করা হয়। তবে মাসের নামের ক্ষেত্রে বাংলা নামগুলোই রাখা হয়। সে সময় থেকে বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা হয়। বাংলা সনের জন্ম ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে এ কথা মোটামুটিভাবে অধিকাংশ পঞ্জিকাবিশারদ মেনে নিয়েছেন। তবে তা গণনা করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ১৫৫৬ থেকে। নতুন সনটিকে প্রথমে ফসলি সন পরে বঙ্গাব্দ বলা হয়।

ইংরেজ আমলে শহরে সরকারি কাজকর্ম চলত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। কিন্তু বাংলার গ্রামে-গঞ্জে জমিদারের খাজনা, পুণ্যাহ, হালখাতা ইত্যাদি চলত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। আবহমান কাল থেকেই বিভিন্ন লোকাচারের মাধ্যমে বাংলায় নববর্ষ পালনের রীতি ছিল। চৈত্রসংক্রান্তিতে মেলা বসত বিভিন্ন স্থানে। চড়ক পূজা হতো। বৈশাখেও মেলা ও স্নানযাত্রার রীতি ছিল। প্রাচীনকালে নববর্ষ ছিল মূলত আতব বা ঋতুধর্মী উৎসব। গৌড়েশ্বর শশাংকের সময়ও নববর্ষ পালন করা হতো। পালন করা হতো পাল ও সেন আমলেও। মোগল আমলে কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষ দিন পর্যন্ত ভূস্বামীদের খাজনা শোধ করতেন। খাজনা শোধের দিনটিকে বলা হতো পুণ্যাহ। পহেলা বৈশাখে ব্যবসায়ীরা নতুন হিসাবের খাতা খুলতেন। এদিন হতো হালখাতা। শুধু খাজনা শোধ ও হালখাতাই নয়, তার সঙ্গে হতো মিষ্টিমুখ করা। এর মাধ্যমে কৃষক-ভূস্বামী, ব্যবসায়ী ও গ্রাহকের মধ্যে হৃদ্যতার সম্পর্ক স্থাপিত হতো।

ক্রমে এ দিনটিকে ঘিরে মেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন হতে থাকে। নৌকাবাইচ, বলীখেলা, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি অনুষ্ঠান দিনটিকে উৎসবমুখর করে তোলে। নতুন বছরে পিঠা-পায়েস খাওয়া, অতিথি আপ্যায়ন চলতে থাকে। কোনো কোনো অঞ্চলে নববর্ষের পূর্ব রাতে স্নানের প্রচলন ছিল। এখনো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা বসে। অষ্টধাতু ভেজানো পানি ঘরদুয়ারে ছিটানো, ঘরদুয়ার পরিষ্কার করা, গরুবাছুরকেও স্নান করানো, ব্যাঙের বিয়ে, মেঘরাজার গান, শিবের গাজন ইত্যাদির প্রচলন রয়েছে অনেক অঞ্চলে। কালের বিবর্তনে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বেশ কিছু জটিলতা ও সমস্যা দেখা দেয়। পঞ্জিকাপ্রণেতা ও জ্যোতির্বিদদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বাংলা বর্ষপঞ্জি। এই অবস্থায় ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নেতৃত্বে সুদক্ষ ও খ্যাতনামা প-িত এবং জ্যোতির্বিদদের সমন্বয়ে একটি বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার উপসংঘ গঠন করে।

পরবর্তীকালে বাংলা একাডেমি শহীদুল্লাহ্ কমিটির প্রস্তাবকে বিবেচনা করার জন্য আরেকটি কমিটি করে নব্বইয়ের দশকে। যার অন্যতম সদস্য ছিলেন ফোকলোর গবেষক ড. শামসুজ্জামান খান এবং ভাষাসৈনিক ও পঞ্জিকা গবেষক মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। কমিটি মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর মূল প্রস্তাবকে গ্রহণ করে সুপারিশ দেয়। বাংলাদেশ সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুমোদন করে ১৯৯৬ সালে বঙ্গাব্দ ১৪০২-০৩ বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে। এর নাম দেওয়া হয় শহীদুল্লাহ্ পঞ্জিকা। এখন যে সরকারি বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু রয়েছে তাতে খ্রিস্টীয় সন ও বঙ্গাব্দের মাসগুলোর তারিখ সব সময়ের জন্য স্থির রয়েছে। ফলে প্রতিবছরই ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হচ্ছে।

পাকিস্তান আমলে বাঙালির জাতীয় পরিচয়, ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর চলে দমন-নিপীড়ন। এর প্রতিবাদে প্রখ্যাত রবীন্দ্র-গবেষক, সংগীতশিল্পী ড. সনজীদা খাতুনের নেতৃত্বে ছায়ানটের উদ্যোগে ঢাকায় রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ধীরে ধীরে বাঙালির প্রধান জাতীয় উৎসবে রূপ নেয় পহেলা বৈশাখ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শহরের মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রা।

বাংলাদেশের সব ধর্মসম্প্রদায়ের এবং বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষসহ সবার সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, ফুলবিজু ইত্যাদি উৎসবের মাধ্যমে নববর্ষকে বরণ করেন। ঢাকাসহ সারা দেশে বর্ষবরণে আয়োজন করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সরকারি ছুটির এ দিনটিতে ঘরে ঘরে সুস্বাদুু খাদ্য ও অন্যান্য আনন্দ আয়োজন থাকে। প্রতিবছরের মতো এবারও উৎসবের প্রস্তুতি চলেছে দেশজুড়ে। মার্কেট ও শপিং কমপ্লেক্সগুলোতে গত কয়েকদিন ছিল উপচেপড়া ভিড়। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। এদেশের বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের বিভিন্ন উৎসব রয়েছে। কিন্তু এই একটি মাত্র উৎসবে সব ধর্মসম্প্রদায় জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ এক উৎসবে মেতে উঠতে পারেন। ১৪২৪ বঙ্গাব্দ বাংলাদেশের জন্য শুভ ও কল্যাণকর হোক। শুভ নববর্ষ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn