জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া ::প্রতি বছরের মত এবারও শীত মৌসুমে অতিথি পাখির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে দেশের বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি টাংগুয়ার হাওর। আশ পাশের ছোট বড় হাওর গুলোতে অতিথি পাখিদের বিচরণ লক্ষ্যনীয়। শীতের পূর্নিমা আর গোর আধার আলোতে পরবাসী বিঙ্গগকুল আর দেশীয় পাখিদের মিলন মেলায় যেন স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে হাওর জুড়ে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠা পানির বিশাল জলাভূমি টাংগুয়ার হাওরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জীব বৈচিত্র্যে। এ হাওরটি সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার প্রায় ১০০কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তুত মেঘালয় পাহড়ের পাদদেশে অবস্তিত। হাওরের ১৮টি মৌজায় ৫২টি হাওরের সমন্বয়ে ৯৭২৭হেক্টর এলাকা নিয়ে হওয়ায় এই হাওর সবচেয়ে বড় জলাভূমি। পানি বহুল মূল হাওর ২৮বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ গ্রামগঞ্জ ও কৃষিজমি। এখানে দ্বীপের মত ছোট বড় ৮৮টি গ্রামে ৬১হাজারের অধিক মানুষের বসবাস করছে বংশ পরমপরায়।আরো জানা যায়, প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট প্রজাতির পাখির আসা যাওয়া কে পরিযায়ী বলে। পৃথিবীর প্রায় ১০হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১হাজার ৮শত ৫৫প্রজাতির পাখি পরিযায়ী। এসব অতিথি পাখিরা প্রতি বছর তুষার পাত ও শৈত্য প্রবাহ থেকে নিজেদের জীবন রক্ষার তাগিদে শীত মৌসুমে শীত প্রধান দেশ সূদুর সাইবেরিয়া,চীন,মঙ্গোলিয়া,নেপাল সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে শুধু ডানায় বর করে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে মায়ার টানেই এই টাংগুয়ার হাওরে।

অতিথি পাখিরা একটানা ডানা মেলে আকাশের উড়ার ক্লান্তিতে এরা প্রথমে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও প্রচুর খাবার সমৃদ্ধ টাংগুয়ার হাওরে বিচরন করে তারা যেন সজিবতা ফিরে পায়। এসব অতিথি পাখি টাংগুয়ার হাওরে কুয়াশাচন্ন সকালের সোনালী রোধে সূর্যস্নান সেরে দলবেদে চষে বেড়ায় ছোট শামুক,ঘাস,শস্যদানা,আর পোকামাকড়ের সন্ধানে হাওরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। উড়ে বেড়ানো আর কলকাকলীতে মুখরিত হাওর পাড়ের গোট এলাকা জুড়ে বিরাজ করছে নয়ানাবিরাম চোখ জুরানো দৃশ্য। বিশাল হাওরের জলে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করা,সামুক খাওয়া,জলকেলি,খুনটুশি আর কিচিরমিচির কলতান পাড়ের মানুষের ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায় আর পাখি প্রেমিদের সহজেই নিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে।

এই হাওরে আগত অতিথি পাখির মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হল,লেঞ্জা বালি হাঁস, সরালী, প্যালাসেস ঈগর, বড় গ্রে কিংস্টর্ক, মৌলভীহাঁস, পিয়ারী,কাইম,কালাকুড়া,রামকুড়া,মাথারাঙ্গা,চোখা হাঁস চোখাচোখি,বিলাশী শালিকসহ প্রভৃতি। আর অতিথি পাখিদের সঙ্গে মিলে আছে দেশীয় পাখিরা হল-পানকৌরি, জলকবুতর, কালি ডাহুক, মাছরাঙ্গা, গাঙচিল, বক, সারস, শঙখচিলসহ হাজারো রখমের পাখি। অতিথি পাখিদের শিকার করার জন্য এক শ্রেণীর অসাধু স্থানীয় ব্যবসায়ী রয়েছে সজাগ। তারা কারেন্ট জাল,বিভিন্ন ফাঁদ দিয়ে পাখি শিকার করার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। আরো জানাযায়,প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র্যের আধার এই হাওর কে বিভিন্ন সমস্যার কারনে ১৯৯৯ সালে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসাবে ঘোষনা করা হয়। পরে ২০০০সালের ২০শে জানুয়ারী রামসার সাইট হিসাবে ঘোষনা করা হয়। ২০০৩ সালের নভেম্বর থেকে ইজারা প্রথা বাতিল করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয় হাওরের জীব বৈচিত্র্য রক্ষা ও রামসার নীতি বাস্থবায়নের উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৯ সালে হাওরে ১৪১ প্রজাতির মাছ, ২শত প্রজাতির উদ্ভিদ, দু-শত ১৯ প্রজাতির পাখি, ৯৮ প্রজাতির পরাযায়ী পাখি, ১২১ প্রজাতির দেশিও পাখি, ২২ প্রজাতির পরাযায়ী হাঁস, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী বিচরণ করত ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-পালাও বর্তমানে এসব এখন হুমকির মুখে।

অতিথি পাখির বিচরনের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে ও বিলুপ্তি বন্ধ করতে হলে সচেতন মহল ও হাওড়পাড়ের হাফেজ এমদাদ,শিক্ষক হাদিউজ্জামান, হুসাইন আহমেদ জানান, অতিথি পাখির নিরাপত্তা,হাওর পাড়ে পাখিদের আবাস্থলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে করা, নির্বিচারে ঝোপঝার,গাছ-পালা উজার বন্ধ করা,বিভিন্ন প্রকার জলজ আগাছা পরিষ্কার না করা,রাসায়নিক সার প্রয়োগ না করা ও ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার করে পাখিদের খাবার উপযোগী (কীটপতঙ্গ) বিনষ্ট না করা ও নির্বিচারে পাখি শিকার বন্ধ করা প্রয়োজন। টাংগুয়ার হাওরে বেড়াতে আসা মেহেদী হাসান জনমেজর ভূঁইয়া(জনমেজর)সহ অনেকেই বলেন,হাওরে অতিথি পাখি আসা শুরু করেছে আর শীতের রাতের আকাশে অতিথি পাখির ডাকে এক বিভিন্ন রখম অনুভুতির জন্ম দিয়েছে হাওর জুড়ে। দিনের আলোতে টাংগুয়ার হাওর জুড়ে দলবদ্ধ ভাবে অতিথি পাখির বিচরন করার চিত্র যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। সাদেক আলী, রফিকুল ইসলাম স্থানীয়রা জানায়,রাষ্ট্রীয় ভাবে অতিথি পাখি শিকার করা দন্ডনীয় হলেও রাতের আধারে মাছ ধরার জালসহ বিভিন্ন ফাঁদ দিয়ে অতিথি পাখি স্থানীয় শিকারীরা শিকার করে।প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সাময়িক বন্ধ হলেও তা একবারেই বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পূনেন্দ্র দেব বলেন, টাংগুয়ার হাওরে পাখি শিকার প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। কাউকেই কোন প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন-অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে টাংগুয়ার হাওরে। হাওর রক্ষা করা জন্য আমার উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত আছে। হাওর পাড়ের প্রতিটি গ্রামে পাখি শিকার বন্ধে ও হাওর রক্ষায় সবাইকে সচেতন করতে হবে তাহলে মাছ ও পাখি শিকার বন্ধ হবে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, টাংগুয়ার হাওরে কোন প্রকার পাখি শিকার করতে দেওয়া হবে না। হাওরে ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োজিত আছে। পাখি শিকার যারা করবে তাদের বিরোদ্ধে কঠোর আইননুগ ব্যবস্থা পূর্বেও নেওয়া হয়েছে এবারও নেওয়া হবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn