আবু মাকসুদ-

নানার বাড়ি যাওয়া আমাদের জন্য আনন্দের ছিল, আফসোস দূরত্বের কারণে নিয়মিত যাওয়া হত না। আমাদের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব অনেকে জানতে চাইত মৌলভীবাজার এবং সুনামগঞ্জের মিলন হল কীভাবে! যখনকার কথা তখন এটাকে প্রায় অসম্ভব ভাবা হত। আমার বাবা মায়ের যখন বিয়ে হয় তখন ব্রিটিশ পাততাড়ি গুটিয়ে বিদেয় হচ্ছে তথাকথিত কায়েদে আজমের বিকৃত পাকিস্তান সত্য হয়ে দেখা দিচ্ছে। এর মাঝে বাবা মা নতুন সংসার শুরু করছে।

বাবার বাড়ি মৌলভীবাজার দুটি পাতা একটি কুড়ি অর্থাৎ চায়ের দেশে, মায়ের বাড়ি সুনামগঞ্জ হাওর বাওর নদী নালার দেশে। দুজনই প্রকৃতি থেকে ওঠে আসা, পরবর্তী জীবন প্রকৃতি কে ভালবেসে কাটিয়েছেন। আমার বাবা সুনামগঞ্জে চাকরি করতেন, তাঁর ভবিষ্যৎ শ্বশুর অর্থাৎ আমাদের নানা ছিলেন বাবার ইমিডিয়েট বস। নানা বাবাকে পছন্দ করে ফেলেছিলেন, পছন্দ হওয়ার মত পাত্র ছিলেন আমার বাবা, ফলশ্রুতি বাবা মায়ের যৌথ সংসার এবং আমরা দশ ভাইবোন।

সুনামগঞ্জ যাওয়া তখনকার দিনে হিমালয় পাড়ি দেওয়ার মত কষ্টসাধ্য ছিল। উঠলাম আর ফুরুত করে পৌঁছে গেলাম তেমন ছিল না। এখন মৌলভীবাজার থেকে সিলেট যেতে সর্বসাকুল্যে ঘন্টাখানেক লাগে কিন্তু তখনকার দিনে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লেগে যেত, আমি বলছি ৭০/৮০ দশকের কথা। মৌলভীবাজার থেকে সুনামগঞ্জ যেতে নিদেনপক্ষে সাত-আট ঘণ্টা, পাঁচটা ফেরি পেরিয়ে যখন সুনামগঞ্জ পৌঁছাতাম পথের ক্লান্তি নিমিষেই হাওয়া হয়ে যেত। সুনামগঞ্জ তখন মহকুমা শহর, শহর বটে কিন্তু আমাদের কাছে সুনামগঞ্জকে বর্ধিত গ্রামের মতোই মনে হতো।

সুনামগঞ্জের বুক চিরে সুরমা প্রবাহিত, আমার জন্ম যে শহরে সেই শহরের বুকে ও মনু প্রবাহিত হয় আমি দুই শহরের মাঝে যোগসূত্র খুঁজে পেতাম। দুই শহরকেই আমার ভীষণ আপন মনে হতো, এখনো হয়। সুনামগঞ্জে আমাদের খাতির যত্ন অতিরিক্ত বেড়ে যেতো, সবাই আমাদের খুশি রাখতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তো। শহরের সবাই আমাদের মামা কিম্বা খালা। যে কয়দিন থাকতাম, আনন্দ-ফুর্তিতে থাকতাম। বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে সারা শহর চষে বেড়াতাম।

সুনামগঞ্জ শহরের আরপিনগনে আমার মায়ের মায়ের বাড়ি অর্থাৎ মায়ের নানার বাড়ি। মায়ের নানার বাড়ির জন্য আমাদের বাড়তি আগ্রহ ছিল। এই বাড়ির মানুষগুলো কিছুটা অদ্ভুত, তাদের সামাজিকতা কিংবা আদর স্নেহ কিছুটা ভিন্ন ছিল। তাদের কথাবার্তায় আন্তরিকতা অনুভব করতাম, তখন আমাদের বয়স ৭/৮। যেকোন বিষয়ে মুগ্ধ হওয়ার বয়স, আমরা এই বাড়ির সবকিছুতে মুগ্ধ হতে থাকি।

এই বাড়ি এক ব্যক্তি আমাদের মুগ্ধতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। আমার মায়ের গোলাপ মামা মুহাম্মদ আবদুল হাই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে থাকেন। তাঁর ঘর বিচিত্র জিনিসে ভরপুর। কাগজের তৈরি টেবিল ঘড়ি, কাগজের তৈরি টেবিল ফ্যান, কাগজের তৈরি ফুল, ফুলদানি। দেয়ালে ঝুলানো কাগজের তৈরি বিচিত্র চিত্রকর্ম আমাদের অবাক করতে থাকে। সবচেয়ে বেশি অবাক করে তাঁর বিশাল লাইব্রেরি। বিরাট বিরাট আলমারি ভর্তি বই, আমাদের হাতছানিতে ডাকতে থাকে, আফসোস অল্প বয়সের কারণে বইয়ের নাগাল না পেয়ে নিরাশ হই। তবু বলেকয়ে বালকদের উপযোগী দুয়েক বই পড়তে সক্ষম হয়েছিলাম। তাঁর বিশাল লাইব্রেরির জন্য আমরা লালায়িত ছিলাম, বহু বিচিত্র বইয়ের সমাহার ছাড়া তখনকার সময়ের নানান ধর্মী ম্যাগাজিন, সাহিত্য কাগজ তাঁর সংগ্রহে ছিল।

মুহাম্মদ আবদুল হাই আমার মায়ের গোলাপ মামা আমাদের গোলাপ নানা সুনামগঞ্জের এক কীর্তিমান পুরুষ। তিনি একাধারে কবি, কথা সাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, পরিচালক। বেশ কিছু গানও লিখেছেন।

এসব পরিচয়ের বাইরেও তাঁর অন্য পরিচয় আছে তিনি একজন রাজনীতিবিদ, সংগঠক। সমাজ সংস্কারক হিসাবে মানুষ তাঁকে স্মরণ করে।

আমার যখন বার বছর বয়স তখন তিনি প্রয়াত হন, তাঁর সাথে গভীর কোন স্মৃতি নাই। তবে ছেলেবেলায় তাঁর লাইব্রেরি এবং বসার ঘরে তাঁর কৃতি অবলোকন করে ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাঁর লাইব্রেরির উপরের তাকের বইয়ের নাগাল না পেয়ে যদিও হাপিত্যেশ করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে মা, খালা, মামাদের মুখে তাঁর কথা শুনে তাঁর জন্য গর্ব করেছি। বই, কবিতা, গান, নাটক কিংবা দেশের জন্য যে দুর্ভাবনা এখনো আমাদের তাড়িত করে তার বীজ গোলাপ নানা পুতেছিলেন কিনা জানিনা, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু প্রভাব তিনি রেখেছেন।

আমাদের অঞ্চলে বারকির মাছ বলে একটা কথা আছে, অর্থাৎ উজানের মাছ। সবাই যখন অনুকূল স্রোতে গা ভাসাচ্ছে তখন বারকির মাছ প্রতিকূলতা ভেদ করে এগোনোর চেষ্টা করছে। আমাদের গোলাপ নানা এমনই এক বারকির মাছ ছিলেন।

তখনকার সময়ের সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটা সহজ ছিল না। পাকিস্তান নামক অদ্ভুত রাষ্ট্রকে অস্বীকার করে বাংলাদেশে পরিণত করা সহজ ছিল না। আমি গর্ব করি আমাদের গোলাপ নানা ছাত্র বয়সেই নিজেকে দেশের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। সেই সময়েই বঙ্গবন্ধুকে আদর্শ ধরে পাকিদের তাড়াতে বঙ্গবন্ধুর হাতে হাত মিলিয়েছিলেন। মুহাম্মদ আবদুল হাই একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা।

মায়ের কাছে শুনেছি গোলাপ নানা নাটক পাগল ছিলেন, নাটকের জন্য দিনের পর দিন বাড়িতে অনুপস্থিত থাকতেন। নাটক লেখা, অভিনয়, পরিচালনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। প্রাক পাকিস্তান কালে সুনামগঞ্জে যত নাটক অভিনীত হয়েছে এতে গোলাপ নানার সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। বাংলাদেশ পর্বেও তিনি নাটকের ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন।

সুনামগঞ্জ আওল বাউলের দেশ। হাছন, রাধারমণের দেশ। আমাদের গোলাপ নানা পূর্বজদের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। পূর্বজদের পাগলামি কিছু মাত্রায় তার উপরেও বর্তে ছিল। তিনি নিজে বাউল অন্তপ্রাণ ছিলেন। হাওরের নৌকায় ভেসে ভেসে নিজেকে উজাড় করে সৃষ্টি রহস্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন, পরমেশ্বর কে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। “বাউলা কে বানাইলো রে” এই জিজ্ঞাসা তাঁকে অনেক রাত বিনিদ্র রেখেছে।

বিপরীত প্রকৃতির মানুষ আমাদের সমাজে অকর্মা বলে পরিচিতি পায়। সমাজ তাদের বোঝা মনে করে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানুষেরা জীবদ্দশায় মূল্যায়িত হয় না। যদিও তারা মূল্যায়নের ধার না ধেরে মানুষের মাঝে জোসনা বিতরণ করে। মানুষকে সুন্দরের আহ্বান জানায়, মানুষকে সত্য পথের সন্ধান দিতে চেষ্টা করে।

কালে কালে এসব মানুষ সমাজের আয়না হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব মানুষের দেখানো পথ ধরে পরবর্তী প্রজন্ম পৌঁছানোর চেষ্টা করে। কালে কালে এসব মানুষ দিকহারা মানুষের বাতিঘর হিসেবে পরিচিতি পায়।

আমাদের গোলাপ নানা এমনই এক আলোকবর্তিকা ছিলেন, যিনি তার সমাজ এবং পরিপাশকে আলোকিত করে গেছেন। মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ বছর পরে তিনি পুনরায় স্মরিত হচ্ছেন, এতে প্রমাণিত হয় তিনি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাননি। এতে প্রমাণিত হয় তিনি যা করে গেছেন নিষ্ফল নয়। এতে প্রমাণিত হয় তিনি তার সমাজে যথেষ্ট প্রভাব রাখতে পেরেছেন।

বারকির মাছ প্রতিকূলে সাঁতার কাটে, তারা ঘোরগ্রস্ত হয়। নিজের পরিচয় উন্মোচনে তারা  আত্মহুতি দিতে দ্বিধা করে না। আমাদের গোলাপ নানা এমনই এক চন্দ্রাহত মানুষ ছিলেন, যিনি সারা জীবন নিজেকে উন্মোচনে হেঁটেছেন। তিনি সফল হয়েছিলেন। তিনি মানুষকে সুন্দরের সন্ধান দিতে পেরেছিলেন। তিনি মানুষকে মানুষের সন্ধান দিতে পেরেছিলেন। তাঁর এক জীবন মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন।

লেখক পরিচিতিঃ-আবু মকসুদ- ইংল্যান্ড প্রবাসী কবি। সম্পাদক ‘শব্দপাঠ’ সাহিত্যের কাগজ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn