বার্তা ডেক্সঃঃসদ্য সমাপ্ত সুনামগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচন, যেটিকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অবাধ-সুষ্ঠু হিসেবে প্রশংসা করেছেন, এমন একটি নির্বাচনে নৌকার কাছে ধানের শীষের শোচনীয় পরাজয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বিএনপিতে। নির্বাচন শেষে পরাজয়ের দায়ভার একে অপরের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন বিএনপি নেতৃত্ব। দু’পক্ষই, অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের সাথে ‘আঁতাতের’ অভিযোগ তুলছেন। ফলাফল দেখে কেউ বলছেন ‘দায়িত্বে থাকা নেতারা সুবিধা লাভের জন্য দুর্বল প্রার্থী মাঠে নামিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বিজয় সহজ করে দিয়েছেন’, তো অন্যপক্ষ বলছে ‘জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বাদে দলের সকল নেতাই নৌকার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায়’ এমন ফলাফল এসেছে।
প্রসঙ্গত, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পদ্ধতি চালুর পর থেকে সুনামগঞ্জ পৌরসভায় টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের কাছে শোচনীয় পরাজয় হয়েছে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির। অধ্যক্ষ শেরগুল আহমেদ, দেওয়ান সাজাউর রাজা সুমনের পর এবার বড় ব্যবধানে হেরেছেন জেলা বিএনপি’র সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মুর্শেদ আলম। নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ২১ হাজার ৬৬৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের নাদের বখত। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি’র মুর্শেদ আলমের ভোট ৫ হাজার ৮৮৫।
এদিকে, ১৬ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ আখ্যা দিয়ে বিএনপি প্রার্থী মুর্শেদ আলম যেখানে প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, সেখানে বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের বিজয়ী প্রার্থীর বিপরীতে এক-চতুর্থাংশ ভোট পাওয়ার নেপথ্যের কারণে খোঁজে হিসেব মিলাতে পারছেন না তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। তারা বলছেন, সুনামগঞ্জ পৌর এলাকায় যেখানে বিএনপি’র সাধারণ ভোটার সংখ্যা বেশি সেখানে পৌর নির্বাচনে ধানের শীষের বার বার কেন এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ধারাবাহিক এই পরাজয়কে তারা দেখছেন ‘নেতৃত্বের ব্যর্থতা’ হিসেবে। আওয়ামী লীগের ‘ভোটের মাঠের খেলোয়াড়’ প্রার্থীর বিপক্ষে ‘বার বার দুর্বল প্রার্থী নির্বাচন’ করায় দলীয় ভোটারদের মাঝে নেতৃত্বের প্রতি চরম আস্থাহীনতা তৈরির ফল এটি। এই আস্থাহীনতা কাটাতে আরো বহুদিন সময় লাগবে বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে, ১৬ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে মেয়র প্রার্থী মনোনয়নের পর থেকেই স্পষ্টত দ্বিধাবিভক্ত ছিল বিএনপি নেতৃত্ব। অতীত নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ‘কেউ যখন প্রার্থী হতে আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না, তখন জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদকের আস্থাভাজন মুর্শেদ আলমকে ‘আকস্মিক’ বিএনপির প্রার্থী করা হয়। তখন তাঁকে প্রার্থী করা বিষয়টিকে বিএনপির অনেকে ‘নিয়মরক্ষা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
এ নিয়ে জেলা বিএনপি’র যুগ্ম সম্পাদক ও পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান সুনামকণ্ঠকে নির্বাচনের পূর্বে বলেছিলেন, “নির্বাচনে যাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে তিনি ব্যক্তিবিশেষের প্রার্থী, দলের কিংবা জোটের নয় – নিয়মরক্ষা করতে গিয়ে তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে। তাঁকে প্রার্থী করার ব্যাপারে কারো সাথে পরামর্শ করা হয়নি।”
নির্বাচনে ধানের শীষ সুবিধা করতে না পারার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, “দুইজন দায়িত্বশীলের কারণে ধানের শীষ পৌরসভায় এতোটাই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে যে, এখন আর এই প্রতীক নিয়ে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় না। আঁতাতের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে বার বার দুর্বল প্রার্থী মাঠে নামানো হয়। এতে করে দল হেয়প্রতিপন্ন হয় এবং নেতাদের দেউলিয়াত্ম ফুটে উঠেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও ১৬ জানুয়ারি যে ফলাফল আসবে সেটা হবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক।”
নির্বাচনে বিপুল ভোটে পরাজয়ের পর বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মুর্শেদ আলম পাল্টা তোপ দেগেছেন নোমনসহ জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি দেওয়ান জয়নুল জাকেরীন, সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট শেরেনূর আলী প্রমুখের দিকে।
নির্বাচন পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় মুর্শেদ আলম বলেন, “এটাকে আমি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন বলব। মাননীয় পুলিশ সুপারকে ধন্যবাদ জানাব, কারণ উনার প্রচেষ্টায় এই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ছাত্রলীগের কিছু ছেলেরা বার বার সেন্টার দখল করতে চেয়েছিল, কিন্তু উনার প্রচেষ্টায় পারে নাই। কিন্তু আমি পরাজয় বরণ করেছি আমার দলের কোন্দলের জন্য। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নূরুল ও ছাত্রদল বাদে টোটাল বিএনপি ইনেক্টিভ ছিল।”
তিনি বলেন, “আমাদের সহ-সভাপতি জয়নুল জাকেরীনের সেন্টারে আমি লিড করতে পারি নাই, সেখানে নৌকা লিড করেছে। পৌর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শেরেনূর আলী, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান, জেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি রেজাউল হক, সেলিম উদ্দিন ভুট্টু নৌকা, অর্থাৎ সেক্রেটারি বাদে জেলা বিএনপির পোস্টধারি সবাই নৌকা ছিল। কেউ আমাকে ভোট দেয় নাই। যে ৬ হাজার ভোট পেয়েছি তার সবগুলো আমার পারিবারিক ভোট, রক্তের মানুষের, আত্মীয়-স্বজনের। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে কাজ করব। তবে আমি এইটুকু বলতে পারি সুনামগঞ্জে নির্বাচন ফেয়ার হয়েছে, আমার কোনও অভিযোগ নেই। আমার ভরাডুবি হয়েছে আমার দলের কারণে।”
মুর্শেদ আলমের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও পৌর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শেরেনূর আলী বলেন, “নির্বাচন পরিবর্তী সময়ে মুর্শেদ আলম গণমাধ্যমে যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, সেখান থেকেই তার অযোগ্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। দলীয় ফোরাম ও সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ না করে ব্যক্তিগত পছন্দে অযোগ্য একজনকে প্রার্থী করায় দলের এমন ভরাডুবি হয়েছে। মূলত, প্রতিপক্ষকে বিশেষ সুবিধা দিতে, বিনিময়ে নিজেরা বিশেষ সুবিধা নিতে দলের কল্যাণ বাদ দিয়ে বার বার ভুল প্রার্থী নির্বাচন করা হয়।”
তিনি বলেন, “মুর্শেদ বলেছেন উনার সাধারণ সম্পাদক ছাড়া নির্বাচনে আর কেউ ছিলেন না – যেটা অত্যন্ত নিন্দনীয় একটি বক্তব্য। তিনি বলেছেন যে ভোট পেয়েছেন, সেগুলো তার পারিবারিক ও আত্মীয়-স্বজনের ভোট, আমাদের প্রশ্ন, তাহলে দলের ভোট গেল কোথায়। উনার সাধারণ সম্পাদকের সেন্টার থেকে আমার সেন্টারে ধানের শীষ বেশি ভোট পেয়েছে।”

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn