শাহরীয়ার বিপ্লব-

এই শহর। এই উপত্যকা। এই সুরমা নদীর বাঁকে। এই হাওরের ঢেউ আর নরোম পলিমাটির ভাঁজে ভাঁজে। হিজল করচ আর ডুমুরের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির আবাহনে অনেক কবি সাহিত্যক রাজনীতিবিদ জন্ম নিয়েছেন। সুনামগঞ্জ শহর আর এই হাওরের জনপদকে এসব মনিষিরা করেছেন উজ্জ্বল উদ্ভাসিত। একেক সময় মহান ব্যাক্তিগন নিজের কর্ম আর গুনের আলো জ্বালিয়ে ব্যক্তিগত স্বত্তার চাইতেও সময়কে করেছেন তাঁদের চাইতেও বেশী প্রজ্জ্বলিত। সেইসব মহান ব্যাক্তিদের মধ্যে ব্যতিক্রম একজন ছিলেন মুহাম্মদ আব্দুল হাই সাহেব।

ব্যতিক্রম ছিলেন এই জন্যেই বলছি। পৃথিবীতে সবাই কিছু না কিছু নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য, নিজেকে প্রসারিত করার জন্যে, নিজেকে প্রচারিত করেন। কেউ কম। কেউবা বেশী। কেউ হয়তো বেঁচে থাকার জন্যেই নিজেকে সাজান। কেউবা মহান হতে চেয়েই মহত্ত্ব করেন। এইখানেই আলাদা করা যায় তাঁকে। শুধু আলাদা হবার জন্যেই যে তিনি এসেছিলেন। জন্মেছিলেন আলাদা হবার বাসনা নিয়েই যেনো। জাগতিক জীবনের সকল হাতছানিতে নিজের ছোঁয়া লাগাতে দেননি তিনি। সেই তিনি আব্দুল হাই সাহেব।

রূপ রস খ্যাতি জশের মোহে কে না হাত বাড়ায়?

যারা সেই খ্যাতি পেয়ে যান। তারাই ইতিহাস হয়ে যান। আর খ্যাতিকে মাড়িয়ে যারা প্রকৃতির সাথে মানুষ এবং মনুষত্যের হৃদয়ের সখ্যতা গড়েন তারা ইতিহাসের চেয়েও বেশী কিছু। আধ্যাত্মিকতা দিয়ে খোঁজে নিতে হয়। মর্ম থেকে মরমের সাধনা দিয়েই তাঁদের ভালোবাসতে হয়। আব্দুল হাই সাহেবকে নিয়ে আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষ এর চেয়ে বেশী আর কিই বা লিখতে পারি?

আজকে আমরা যারা নুতন প্রজন্ম। সুনামগঞ্জ বা বৃহত্তর সিলেটের সমসাময়িক যাঁদেরকে আমরা খুব স্মরণীয় রাজনীতিবিদ বা শিক্ষা সংস্কৃতিবিদ হিসাবে আলোচনায় রাখি। কিংবা ইচ্ছা অনিচ্ছায় রাখতে চাই। তাঁদের অনেকের আগমন ঘটিয়েছিলেন তিনি। কখনো আগন্তুকদের উচ্চাবিলাসিতাকে স্নেহের দান কিংবা নিজের উদারতায় নিজে নিজেই ক্ষমতা আর পদবীর মঞ্চ থেকে স্বেচ্ছায় প্রস্থান করেছেন। হয়েছেন ঐশ্বরিক আনন্দে মহীয়ান। তারুন্য থেকে যৌবন পর্যন্ত ছিলো যার দুর্বার দূরন্ত। প্রতিবাদ দ্রোহ বিপ্লবের ভরপুর। সামরিক দুঃশ্বাসনের রক্ষচক্ষু যাঁকে পরাস্ত করতে পারে নি। কারাগারের ভিতর থেকে যিনি বি এ পাশ করেছিলেন। ৪৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে একমাত্র তিনিই কৃতিত্বের সাথে পাশ করে মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সেই তিনি যৌবন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত উদারতা আর পার্থিব মোহ ত্যাগ করে হয়ে গেছিলেন অনেকটা সুফি সাধকের মতো।

ভব তরঙ্গের পানে জীবন সাঙ্গ করলেন নির্মোহ বিরাগীর মতো।

আমি জানি না। উনার আত্মীয়রা কি বলবেন। বিরাগী সবাই হতে পারে না। অনেকে সৌখিন বিরাগী বা বাউল হতে চাইলেও বাউলিয়ানা সবাইকে গ্রহন করে না। এইখানেও তিনি অন্যরকম ব্যতিক্রমী বাউল। যিনি নিজে বাউল হতে না চাইলেও জীবনের মর্ম ভেদ করে বাউলিয়ানা তাঁকে করেছিলো বিবাগী বাউল। রাজনীতিবিদেরা মৃত্যুর পূর্বে তো বটেই, মৃত্যুর পরেও রাজনীতিবিদ থাকতে চান। আর সে লক্ষ্যেই জীবন চালিত করেন।

আমি বলবো মহাব্যতিক্রমের উদাহরণ একমাত্র সুনামগঞ্জের আব্দুল হাই সাহেব।

যখন বাংলার আকাশ ছিলো মেঘে ঢাকা। কাল বৈশাখের তীব্র ঝড় ঠিক সুনামগঞ্জের আকাশেও উড়ছিলো। রাজনীতি ছিলো মুসলিম লীগের নিয়ন্ত্রনে। ক্ষমতার দাপট ছিলো আইয়ুব শাহীর আনুগত্যদের। রাজনীতিবিদগন অনেকেই তখন বামের সাথে। কেউ বা নেপথ্যে, কেউ বা ছদ্মবেশে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের তখন হাঁটি হাঁটি পা পা। ছোট্ট গ্রামীণ জনপদের যারাই রাজনীতি সচেতন প্রায় সবাই যে সোভিয়েত ঘরানার। আর শিক্ষিত মুসলিম পরিবারের চৌধুরী, দেওয়ান বা তালুকদারেরা তো আভিজাত্য আর কৌলিন্য রক্ষায় মুসলিম লীগের বাইরে যাবার সুযোগ নেই। এর মধ্যে উঠতি তরুন, ছাত্র আর প্রতিবাদী যুবকদের পুঁজিকরে সারাদেশে আওয়ামী লীগের চলছে বন্ধুর যাত্রা।

এই যাত্রায় সুনামগঞ্জের নবসূর্যোদয়ের মতো এগিয়ে এলেন মুহম্মদ আব্দুল হাই। গোপনে নয়। লুকিয়েও নয়। বরং খুব সাহসের সাথে। কিন্তু নীরবে। নিজেকে নেতৃত্বের আসনে নয়। বরং নেতৃত্ব তৈরির কঠিন দায়িত্ব নিয়ে। একজন দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক আদর্শিক মনোবলের একজন দক্ষ সংগঠক হিসাবে। যদিও তাঁর রাজনীতি সচেতনতা বা রাজনীতির মনোযোগের যোগান দিয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন।

একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দার্শনিক হিসাবে তিনি যৌবনেই বুঝতে পেরেছিলেন এ দেশের মানুষের মেজাজ, চরিত্র আর জাতীয়তাবাদী ভাবধারার রাজনৈতিক দল এবং নেতৃত্ব ছাড়া পাকিস্থানি সামরিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। তাই তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সুনামগঞ্জ মহকুম আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক হন। অনেকে তখন মুসলিম লীগ আর কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্য কোনও দলই চিনতেন না। অনেকে বটতলা আর স্কুলের বারান্দা ছাড়তেন না সামরিক ফরমানের ভয়ে। যাঁরা অনেকেই তাঁর হাত ধরেই পরে আওয়ামী লীগের আইকন হয়েছেন।

৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময় যে সাংগঠনিক শক্তি ও দক্ষতার মাধ্যমে তিনি নিজেকে পাকিস্থানের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একজন আজন্ম বিদ্রোহী হিসাবে হাওরের বুকে গর্জে উঠেছিলেন। ৫৪ যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় এরচেয়েও বেশী আবেদন ও অহংকার নিয়ে হাওরের জলেস্থলে প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারনায় ঢেউ তুলেছিলেন। যদিও তাঁকে প্রার্থী হতে অনেকেই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি যে নিজে কিছু হতে চান নি। বরং নেতা বানাবার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

৬ দফা, ৬৯ এর গন অভ্যুত্থানের সময় তিনি ছিলেন হাওরের গর্জন। একদিকে রাজনৈতিক মঞ্চ অন্যদিকে পত্রিকার পাতা। কলম আর কণ্ঠ সমান্তরাল হয়ে গিয়েছিলো। সাংবাদিক, সম্পাদক, কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, হিসাবে যেমন পত্রিকা গরম করতেন একইভাবে বক্তব্য, গান, নাটক আর অভিনয় দিয়ে মঞ্চকে করেছিলেন আইয়ুব ইয়াহিয়া বিরোধী আন্দোলনকে উত্তেজিত, উদবেলিত, উজ্জীবিত। এই বহুমাত্রিক রাজনীতিবিদ। বহুমুখী প্রতিভার অনন্য মেধাবী মানুষটি ৭০ সালের নির্বাচনটিও করতে চান নি বা করতে পারেন নি। রাজনীতির জটিল হিসাবের সাথে কোনও দিন তিনি জীবনের অংক মিলাতে পারেননি।

৮০ সালে একবার আমার ফুফাতো ভাইয়ের (ফয়জুর রহমান সাহেব, আমরা যাকে লাল ভাই ডাকতাম) সাথে উনার বাসায় গিয়েছিলাম। লাল ভাই আমাকে হাসননগরের বাসা থেকে রিকশায় আরপিন নগর নিয়ে গেলেন। উনার সম্মন্ধে কিছুই জানতাম না। এই এলাকার শাহীন ছাড়া আর কাউকে তেমন চিনতাম না। নেক ভাই জগলুল ভাই আর পানামা হোটেলের মালিক মতি মামা ছাড়া কারো নামও জানতাম না। আব্দুল হাই সাহেবের কাছে আব্বার কিছু ঋন ছিলো। ৭৯ সালে আব্বা আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। তখন রাহমানিয়া প্রেসের মালিক আফাজ সাহেব আব্বার জন্যে কিছু পোস্টার পাঠিয়েছিলেন। আফাজ সাহেবের কাছে লাল ভাই টাকা দিতে গেলে তিনি ফেরত দেন। আমার হাতে ৭০০ টাকা ফেরত দিয়ে বললেন, তোমার আব্বাকে বলিও বাড়ীতে না থেকে টাউনে চলে আসতে।

আব্দুল হাই সাহেবের কাছেও সেই জাতীয় কিছু ঋন ছিলো। লাল ভাই খুব জ্ঞানী ও সাহসী মানুষ ছিলেন। আব্দুল হাই সাহেবকে তিনি মামুজি ডাকতেন। স্পষ্টতই মনে আছে হাই সাহেব লাল ভাইকে বললেন, ‘আমজাদ মিয়ারে কইও বঙ্গবন্ধুর দলের জন্যে যা করি তা আর ফেরত নেই না। ‘

বিষয়টি এ জন্যেই উল্লেখ করলাম। উনি যখন মারা গেলেন আমি জুবিলী স্কুলের ছাত্র। আমার আব্বা তিন দিন পরে সুনামগঞ্জে এলেন। আব্বারা তখন রাজনৈতিকভাবে অনেকটাই পর্যদুস্ত। আমি স্কুল পালিয়ে মিছিল টিছিলে চলে যেতাম। আব্বা আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন। একদিন বিকালে আলেয়া ফার্মেসীতে বসে কয়েকজনের সাথে বার বার হাই সাহেবকে নিয়েই কথা বলছিলেন। আব্বা খুব আফসোস করেই বলছিলেন ভাইসাবের ঋন টা শোধ করতে পারলাম না।

মুসলিম সমাজ থেকে উঠে আসা একজন অসাম্প্রদায়িক নেতা এই শহর ছেড়ে চলে গেলেন এই অভিব্যক্তি সবার মূখেই ছিলো। আজকের দিনের মতো সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরর উথ্যান সেদিন না হলেও সচেতন সংখ্যালঘুরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন আব্দুল হাই সাহেবের মতো মানুষের প্রস্থান মানেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিতটা যেনো একটু কেঁপে উঠেছিলো। আব্দুল হাই সাহেব একজন মানুষ হিসাবেই বড় হয়েছিলেন। মুসলিম বা হিন্দু হিসাবে নন। তাঁদের একহাত “দেবতার মন্দিরে পূজার জন্যে নিবেদিত আর অন্য হাত পীরের দরগায় শিরনী চড়াত। “

এইরকম একটা মানবতার শিক্ষা তিনি আক্ষরিক অর্থেই লালন করেছিলেন। ভিতরের মানুষটাকে তিনি কখনোই রাজনীতিবিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি বলেই রাজনীতি থেকে মনের অজান্তেই দূরে সরে গিয়েছিলেন। রাজনীতির দাবাখেলা বাদ দিয়ে তিনি ঈশ্বর পরমেশ্বর আর প্রকৃতির মধ্যেই নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। পেয়েছিলেন কি না জানি না। কিন্তু সঁপে দিয়েছিলেন সাধনা আর আধ্যাত্মিকতায়। অভূত সম্ভাবনাময় উচ্চ মেধাবী ব্যাক্তিত্বের নিজেকে জাতীয় রাজনীতির মঞ্চ থেকে সুনামগঞ্জের হাওরের জলের সাথেই মিলিয়ে দিয়েছিলেন। ইচ্ছা করলেই তিনি রাজনীতির দাবা খেলায় মন্ত্রী উজির হতে পারতেন। সাপলুডু খেলার মই বাওয়া তাঁর চেয়ে বৃহত্তর সিলেটে আর কেউ হতে পারতো কিনা সন্দেহ আছে।

কিন্তু সুনামগঞ্জের সুনীল আকাশ। মেঘালয়ের পাদদেশের সবুজের মাঝে, হাওরের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে দুলতে দুলতে বিল ঝিল আর শাপলা সালুকের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। হাছনের গানে খোঁজতেন জীবনের মর্মকথা। বাউলের গানে আর জারি সারিতে খোঁজতেন মানুষ কেন আসে। কেনই বা চলে যায়। কিই বা রেখে যায়। পার্থিব সবকিছুকে দূরে ঠেলেই বিবাগী হয়েছিলেন।

এই মহান মানুষের জীবন কাহিনী আজকের প্রজন্মের জন্য শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। বর্তমান ভাসমান ডিজিটাল প্রজন্মকে ধ্যানি জ্ঞানী করে তুলতে হলে আব্দুল হাই সাহেবের মতো একজন সাধক উদাহরণ হতে পারে নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে আওয়ামী রাজনীতির সাথে যারা জড়িত আছেন বা থাকতে চান তাদের জন্য এই মুজিবভক্ত অসাম্প্রদায়িক নির্মোহ মানুষটি হতে পারে হাওরাঞ্চলের দর্শন। তাঁকে নিয়ে গবেষণা করা আজকের সময়ের দাবী বলে মনে করি। ইশ্বর তাঁর আত্মাকে শান্তি দিন।

লেখক পরিচিতি-শাহরীয়ার বিপ্লব-সাবেক ছাত্রনেতা

 

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn