ওষুধ শিল্পের উৎপাদিত পণ্যকে ২০১৮ সালের ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা   করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার (ডিআইটিএফ) উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মুন্সীগঞ্জে ওষুধের কাঁচামালের প্ল্যান্ট স্থাপন করছি। এই প্রোডাক্ট বিদেশে রপ্তানি হয় এবং তা দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখছে। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের জন্য কাঁচামালসহ ওষুধকে ‘প্রোডাক্ট অফ দি ইয়ার’ ঘোষণা করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প একটি উচ্চ প্রবৃদ্ধির শিল্প। দেশের চাহিদার ৯৮ ভাগ যোগান দিয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকাসহ সারা বিশ্বব্যাপী শতাধিক দেশে আমাদের এই ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমার বিশ্বাস তৈরি পোশাক শিল্পের মতো এই শিল্প অচিরেই আমাদের জন্য, দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনবে। তিনি বলেন, বিশাল সমুদ্রসীমা আমরা অর্জন করেছি। এই সমুদ্র সম্পদকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এই সম্পদ আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাট অবদান রাখতে পারে। আমরা সেদিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করছি। ২০১৭ সালে চামড়া খাতকে প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার ঘোষণা করেছিলাম। চামড়া শিল্পের উন্নয়নে আমরা অনেক কাজ করেছি।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ীদের বিদেশে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করে তাকে কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, দেশের রপ্তানি খাতকে সমৃদ্ধ করতেই এটি জরুরি। তিনি বলেন, আমাদের শুধু একদিকে তাকালে চলবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নতুন দেশ, নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বের করতে হবে, নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে এবং সেইসব বাজারে কোন ধরনের পণ্য রপ্তানি করা যায় সেটাও খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের মান নিশ্চিত করা, ব্রান্ডিং করা এবং এগুলোকে আকর্ষণীয় করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যা যা সাহায্য করার তা তার সরকার করে যাচ্ছে এবং করে যাবে বলেও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবসময় মাথায় রাখতে হবে বর্তমান বিশ্ব অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। এই প্রতিযোগিতাময় বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তিনি ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকদের বলেন, শুধু নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতা আনলেই হবে না। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়াতে হবে। আপনার উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো একান্তভাবেই প্রয়োজন।
বহির্বিশ্বে বর্তমান সরকারের ব্যবসা-বাণিজ্য সমপ্রসারণের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরো ১২টি দেশে নতুন দূতাবাস এবং ১৭টি মিশন খুলেছি। সে সব দেশের অ্যাম্বাসেডর, হাইকমিশনারদের ডেকে ওয়ার্কশপ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং দেশে বিনিয়োগ কিভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরফলে ব্যবসার দ্বার আরো উন্মুক্ত হবে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশীয় উদ্যোক্তারা তাদের নতুন পণ্য প্রদর্শনীর সুযোগ পান। আবার দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের রুচি ও চাহিদার একটি চিত্রও তারা পেয়ে থাকেন। ফলে পণ্যের মানোন্নয়ন ও বহুমুখী করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।  শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিশ্বের ৪৬তম বৃহত্তম অর্থনীতি। গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.২৮ শতাংশ। এখন আমদানি ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণ আয় থেকে মেটানো হচ্ছে। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক অধিকাংশ সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে ১৯৯টি দেশে ৭৫০টি পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে। ২০১৬-২০১৭ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৪.৮৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলার। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের অবস্থান আরো সুসংহত হবে।  আমাদের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাভাবিকভাবেই একটা দেশকে উন্নয়ন করতে হলে শিল্পায়নে যেতে হবে। কিন্তু, কৃষিকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। কৃষিটা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, কৃষির মধ্য দিয়েই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। অর্থনীতি ত্বরান্বিত করতে শিল্পায়নটাও করতে হবে। আবার রপ্তানিও করতে হবে।  শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার তাদের অর্থনৈতিক নীতিমালায় গ্রামকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। পণ্য ব্যবহারে গ্রামীণ জনগণের ক্ষমতাটা যেন বাড়ে, আপনাদের উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে তারা যেন তাদের জীবনমান উন্নত করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, সেই সঙ্গে আর একটা পদক্ষেপ আমাদের আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক রেখে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো।
ভাষণের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান এবং নতুন বছর সবার জন্য আরো উন্নতি এবং প্রগতি নিয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বণিজ্যমেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন। অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এমপি বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সুভাশীষ বোস এবং ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্য স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে দেশের বাণিজ্য খাতের অগ্রগতি নিয়ে একটি তথ্যচিত্র ‘উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ প্রদর্শিত হয়।
ইপিবি সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাণিজ্যমেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৮৯ স্টল ও প্যাভিলিয়ন থাকছে। মেলায় ১৭ দেশের ৪৩ প্রতিষ্ঠানের স্টল বা প্যাভিলিয়ন থাকছে। দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য থাকছে দুটি শিশুপার্ক, সুন্দরবনের আদলে একটি ইকোপার্ক।
নিরাপত্তায় মেলায় পুলিশ ও র‌্যাবের ওয়াচ টাওয়ারসহ আনসার ও ভিডিপি, পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, বিজিবি এবং র‌্যাব সদস্যরা মোতায়েন থাকছেন। সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য ১০০টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। বাণিজ্যমেলায় কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে। প্রবেশ ফি প্রতিজন ৩০ টাকা। ছোটদের জন্য ২০ টাকা।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn