বার্তাডেক্সঃ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই বেশ কিছু পরামর্শ ইতিমধ্যেই বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ভর্তুকি কমানোসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর পরও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের কৌশল সম্পর্কে  জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। ৪৫০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি সামনে রেখে আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়নে দেশের মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা, ব্যাংকখাতে তারল্য সংকটসহ বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল আইএমএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তেনেত মনসিও সায়েহের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে। এ সময় গভর্নরের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা।  সোয়া এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানান, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিগুলো কীভাবে প্রণয়ন করা যায় এবং তার প্রয়োগ করার কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির প্রভাব মোকাবিলায় আইএমএফ কোন কোন খাতে অর্থায়ন করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে আইএমএফ। আগামী ৩১শে জানুয়ারি আইএমএফের বোর্ড সভায় ঋণ চূড়ান্ত হবে বলে প্রত্যাশা বাংলাদেশ ব্যাংক মুখপাত্রের। ওইদিন আইএমএফ বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

 ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন হলে বেশ কিছু কঠিন শর্ত মানতে হবে বাংলাদেশকে।  এর আগে সরকার আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে চিঠি দেয়ার পর আইএমএফের একটি দল গত ২৬শে অক্টোবর থেকে ৯ই নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে আইএমএফ প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে। চলতি মাসের শেষে আইএমএফ বোর্ড বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করবে এবং ফেব্রুয়ারির শুরুতেই ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে। চূড়ান্ত আলোচনার জন্য আইএমএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) পাঁচ দিনের সফরে শনিবার ঢাকায় এসেছেন। আইএমএফের উচ্চপদস্থ এই কর্মকর্তা ১৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীতে থাকবেন। সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বর্তমান বৈশ্বিক মন্দা এবং অন্যান্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের বিষয়ে সায়েহ আইএমএফ সদর দপ্তরে রিপোর্ট করবেন।

তার প্রতিবেদন আইএমএফের বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হবে। এর ভিত্তিতে ঋণ দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হবে। সরকার আশা করছে, চূড়ান্ত অনুমোদনের পর ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে। সেই হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে মিলতে পারে ৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ৪৫ কোটির প্রথম কিস্তি। ২০২৫ সাল পর্যন্ত মোট ৭ কিস্তিতে মিলবে পুরো ঋণের অর্থ।  আইএমএফ বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা চলছে। ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে মার্কিন ডলার, যা আঘাত করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। আইএমএফের দিক থেকে সহায়তা দেয়ার পদক্ষেপ এ কারণেই নেয়া হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিই ছিল। বাণিজ্য ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ, মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকুচিত হওয়ার কারণে সংকটের কাছাকাছি রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ পাচ্ছে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সহায়তা করবে বলে আশা করছে সংস্থাটি। জানা গেছে, সরকার আইএমএফের সঙ্গে ঋণ নিয়ে একটি নীতিগত চুক্তিতে পৌঁছেছে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার অপেক্ষা। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি বাংলাদেশকে ৩টি বিভাগে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে।  বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, বিভিন্ন সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার পক্ষে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে আইএমএফের সঙ্গে কথা হয়েছে। বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের পদক্ষেপ তুলে ধরেছি। তারা (আইএমএফ) এসব নিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছেন।

আইএমএফের কোনো কোয়ারি (প্রশ্ন) ছিল কিনা জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, তারা জানতে চেয়েছেন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আমরা কী কী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। আমরা তাদের কাছে সেসব চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছি। তারা শুনেছেন এবং প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, আর্থসামাজিক খাত নিয়েও তারা কথা বলেছেন। বৈশ্বিক অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জ সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি সেসব বিষয়ে তারা জেনেছেন। আমরা যে প্রো-অ্যাকটিভ ইকোনমিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গিয়েছি সেটা নিয়ে কথা বলেছেন। সব বিষয় তারা শুনেছেন এবং প্রশংসা করেছেন। মূলত পাঁচ ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশকে করতে হবে। যেমন সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতির কাঠামো আধুনিক করা, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, বাণিজ্য পরিবেশ ভালো করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার সামর্থ্য বাড়ানো। এই পাঁচ ধরনের বিষয়ের মধ্যে মূল বিষয়গুলো হচ্ছে, সরকারের ভর্তুকি কমাতে হবে, যাতে সরকার বেশি অর্থ উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে ব্যয় করতে পারে। এ জন্য সরকারকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, পানি ও সারের দাম বাড়াতে হবে। এই পাঁচ পণ্যেই সরকারকে বেশি ভর্তুকি দিতে হয়। সরকার এ কাজ সহজেই করে ফেলছে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর শর্তও এবার রয়েছে।

এ জন্য নানা খাতে যেসব করছাড় দেয়া হয়, তা কমাতে বলেছে আইএমএফ।  এদিকে ডিএমডি’র ঢাকা সফর উপলক্ষে আইএমএফের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার পটভূমিও তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, বিশ্ববাজার উত্তপ্ত এবং ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে ডলার, যা আঘাত করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। এ কারণে আইএমএফের দিক থেকে সহায়তা দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাণিজ্য-ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ ও মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সংকটের সীমানায় রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। অথচ বৈশ্বিক মহামারি এবং মহামারি-পরবর্তী সময়ে বিশ্বে অর্থনৈতিক যে মন্দা দেখা দিয়েছে, তার আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিই ছিল। আইএমএফ বলেছে, সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ পাচ্ছে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সহায়তা করবে।  সংস্থাটির বাড়তি ৪৫০ কোটি ডলার স্বল্প মেয়াদে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির চাপ প্রশমিত করবে। এ ছাড়া আইএমএফের পরামর্শ অনুসরণ করে বাংলাদেশকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও সহায়তা করবে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, মধ্যমেয়াদি স্থিতিশীলতা, মূল্যস্ফীতি কমানো ও রপ্তানি বৃদ্ধি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn