বার্তাডেক্সঃ ফারজানা আক্তার মিলি। স্পোর্টসম্যান। ব্যাটমিন্টন খেলতেন। পরিচিত মুখ। ৭ই জানুয়ারি মিলির মরদেহ নিজ  ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার হয় স্বামী নুর আলম। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন তথ্য। মিলির একটি ডায়েরিতে না বলা অনেক কথা উঠে এসেছে। পরিবারের দাবি একদিনে নয়, ধুঁকে ধুঁকে মারা হয়েছে মিলিকে।

জীবদ্দশায় মিলি না পেরেছিলেন বলতে, না পেরেছিলেন সইতে। একটি ডায়েরিই ছিল তার জীবনসঙ্গী। সেখানেই মনের অনেক কথা লিখে গেছেন। মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার লেখা ডায়েরিতে মিলি তুলে ধরেছেন তার জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নির্যাতনের কথা। জগন্নাথপুর পৌর শহরের মেয়ে মিলি। পড়ালেখার সুবাদে সিলেট নগরেই তার বসবাস। প্রায় ৪ বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন দিরাইয়ের ছেলে নুর আলম ওরফে শ্রাবন আলমকে। অনলাইনে পেশাদার জুয়াড়ি নুর আলম ছিলেন টাকার জন্য অস্থির। নিজের বাড়ি বিক্রির টাকা, মিলির স্বর্ণালঙ্কার, স্ত্রীর নামে ব্যাংক ঋণের টাকা সবই উজাড় করে দিয়েছেন জুয়া খেলায়। মিলির বড় ভাই সাংবাদিক আমিনুল হক শিপন জানিয়েছেন, ‘বিয়ের পর থেকে মিলির উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায় নুরে আলম। এজন্য হাসপাতালে যেতে হয়েছিল মিলিকে। অন্তত ৭-৮ বার মারধর করে মিলিকে রক্তাক্ত করে। মিলির মোবাইল ফোনে সবই ছিল। কিন্তু সেই মোবাইল ফোনটি নেই। তবে কিছু কিছু ছবি তাদের পরিবারের কাছে রয়েছে। এতে দেখা গেছে; কখনো মিলির মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, কখনো নাক দিয়ে। আবার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তিনি জানান, ‘এসব নির্যাতনের কথা কিছু অংশ ডায়েরিতে লিখে গেছে মিলি। এসব পড়ে এখন পরিবারের সদস্যরাই জানতে পারছেন; মিলির উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। এ কারণে এখন আমাদের ধারণা স্পষ্ট মিলিকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এরপর লাশ ঝুলিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছে।’

মিলির বড় বোন মামলার বাদী সুহেলী জানিয়েছেন, ‘ঘটনার আগের দিন তিনি বারবার মিলির রুমে ঢোকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ওর স্বামী নুর আলম তাকে বাধা দিয়ে আটকে রাখে। এমনকি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দরোজা বাইরে থেকে তালা দিয়ে যায়। এ কারণে মিলির কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন তিনি।’ এদিকে ডায়েরির এক পৃষ্ঠায় মিলি লিখেছেন- ‘আমার জীবনে তোমার আগমন বসন্তের মতো ছিল। কিন্তু তোমার প্রতিনিয়ত ব্যবহার আমার কাছে কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ার মতো মনে হয়। যা আমার হৃদয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। যখন আমার কাছে থাকতে চাওনা তখন কেনো বারবার আমার মন ভাঙো আর গড়ো।’

মিলির সেই ডায়েরি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে; ২০২১ সালের শেষদিকে মিলি ডায়েরিতে এসব কথা লিখেন। মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগে। ডায়েরিতে মিলি নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। সংসার টিকিয়ে রাখার আকুতি ছিল। কিন্তু স্বামীর একের পর এক আচরণে মিলি কাহিল হয়ে পড়েছিল। ডায়েরিতে মিলি লিখেছেন-‘জানি আমি বেশি দিন বাঁচবো না। তাই নিজ থেকে আস্তে আস্তে তোমার জীবন থেকে চলে যাচ্ছি। আজ সারারাত অনেক বেশি কাঁদলাম। কেনো আমার জীবনে এতো কষ্ট আসে।’ অপর এক পৃষ্ঠায় মিলি লিখেন-‘আমি যাকে নিয়ে সংসার করছি সে মন থেকে যদি আমাকে ভালোবাসতো কোনো দিনও আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতো না। একটুর মধ্যে রাগ করে আমাকে একা বাসায় রেখে চলে যায়। হাসপাতালের বিছানায় রেখেও পালিয়ে যায়। আমি ওর সামনে অনেক কান্দি তবু সে ঠিক হয় না। আমার বিবেক আমাকে স্বার্থপর হতে দেয় না। এখন থেকে আমি আমাকে বদলে দেবো। আবেগ আর দেখাবো না। জীবনে অনেক কেঁদেছি, অনেক মাইর খেলাম, কী পেলাম। সবাই স্বার্থপর হতে পারলে আমি কেনো হতে পারবো না।’ ডায়েরির শেষ দিকে মিলি লিখেন- ‘সব সময় নিজেকে একা ভাবি কারণ জানি আমার পাশে থাকার মতো কেউ নেই। মাঝে মাঝে কাউকে কাউকে খুব বেশি আপন মনে করি পাশে গিয়ে দেখি সব আমার স্বপ্ন। এ পৃথিবীতে কেউ কারও আপন হয় না। স্বার্থের পৃথিবীতে স্বার্থ হলো প্রতিটা মানুষের আপনজন। আমি নিজের স্বার্থ কোনো দিন বুঝলাম না। আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল।’

এদিকে থানায় মামলা দায়েরের পর পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। নানা বিষয় পর্যালোচনা করছে পুলিশ একই সঙ্গে পোস্টমর্টেম রিপোর্টেরও অপেক্ষায় রয়েছে। কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) আবুল কাহের জানিয়েছেন, মামলার তদন্ত চলমান। মেডিকেল রিপোর্ট আসার পর সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করা হবে। পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, বিয়ের পর থেকে নুর আলমের আসল রূপ বেরিয়ে আসে। সে স্ত্রীকে সময় না দিয়ে অধিকাংশ সময়ে ও রাতে মোবাইল নিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলার পাশাপাশি মদ, ইয়াবা ও ফেন্সিডিলের নেশায় মত্ত থাকতো। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসায় টাকা ইনভেস্ট করে; কিন্তু পরে তা তুলে নিয়ে জুয়া খেলায় সব খুঁইয়ে ফেলতো। সে কখনো মিলিকে স্বর্ণালঙ্কার কিনে দিলে পরে জোর করে খুলে নিয়ে যেতো। মিলির নিজের স্বর্ণালঙ্কারও সে ছিনিয়ে নেয়। তাই মিলি বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বিদেশ থেকে স্বজনদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা আনতেন।

মিলির মায়ের মৃত্যুর আগে অসুস্থ থাকাকালীন সময় আমেরিকা থেকে ধাপে ধাপে ৮ লাখ টাকার বেশি মিলির একাউন্ট ও বিকাশে আসে। উত্তোলন করার টাকার একটি অংশ বাসায় রাখলে নুর আলম জোর করে  নিয়ে জুয়া খেলায় খুঁইয়ে ফেলে। এই নিয়ে সিলেট নগরীর হাওয়াপাড়া নিবাসী ও আমেরিকা প্রবাসী মিলির বড় বোন খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন। মিলির বোন সোহেলীর পরিবার একই ফ্ল্যাটে থাকায় খেলা হেরে নুর আলম প্রায় মিলিকে চাপ দিতো আপার কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসো। মিলি সোহেলীর কাছ থেকে পরে দিবে বলে ধাপে ধাপে কয়েক বছরে ২০ হাজার, ৩০ হাজার, ৫০, ৮০ হাজার করে  ৫ লাখ টাকার কাছাকাছি  নিয়ে নিঃস্ব করে দেয়।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn