বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কমিটি গঠন নিয়ে ‘ভয়াবহ’ অন্তর্দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের রেশ কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি এক বৈঠকে সেক্রেটারি জেনারেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। আর এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে প্রভাবশালী নায়েবে আমীর আতাউর রহমানকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দলের আমীর ও সেক্রেটারি জেনারেল কোনো নিয়ম-কানুন অনুসরণ করেননি বলে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে এক যুগেরও অধিক সময় রাজশাহী মহানগর আমীরের দায়িত্ব পালন করা আতাউর রহমানের বহিষ্কার আদেশে চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের বেশির ভাগ সদস্য। শুধু নির্বাহী পরিষদ সদস্যরাই নয়, উত্তরাঞ্চলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

নির্বাহী পরিষদের এক নেতা বলেন, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আমীর মকবুল আহমাদ ও সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই স্বৈরাচারী কায়দায় দল পরিচালনা করছেন। মনে হচ্ছে, এর মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গঠনতন্ত্র মেনে তারা যদি দল পরিচালনা না করেন, তাহলে নির্বাহী পরিষদের যে কোনো বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হবে। সেখানে মেয়াদপূর্তির আগেই নতুন কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হতে পারে। এই নিয়ে তাদের মধ্যে অতিসতর্কতার সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে বলেও জানান এ জামায়াত নেতা।

জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের নেতাকর্মীরা কীভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন তা নিয়ে নিজের মধ্যে আলোচনা করছেন। কেউ কেউ একযোগে পদত্যাগ করার হুমকি কেন্দ্রকে জানিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কোনো নেতা নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

জামায়াতের একটি সূত্র জানায়, নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপার্জিত অর্থের একটি অংশ চাঁদা হিসেবে দলের ফান্ডে জমা দেয়া হয়। এ অর্থ দিয়েই মূলত দলের সব ধরনের ব্যয় ও কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড হয়। কিন্তু বিগত সময়ে এ অর্থ ব্যয় করা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু এবারই ব্যতিক্রম হয়েছে। এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে জামায়াতের নায়েবে আমীর আতাউর রহমান সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ফান্ডের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনেন। ডা. শফিক যুক্তিসঙ্গত জবাব দিতে না পেরে ওই বৈঠকে আতাউরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এতে আতাউর দমে যাননি। তিনি এ বিষয়টি নির্বাহী পরিষদে তুলবেন বলে ডা. শফিককে ওই বৈঠকেই জানিয়ে দেন।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় এক নেতা জানান, ওই বৈঠকটি ছিল ২২ ফেব্রুয়ারি। সেখানেই উল্লিখিত অভিযোগ নিয়ে বিতর্ক হয়। আতাউরকে অভিযোগ নিয়ে নির্বাহী পরিষদে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে আমীর ও সেক্রেটারি জেনারেল সিন্ডিকেট পরদিন তড়িঘড়ি করে নামমাত্র একটি বৈঠক করে সেখানে আতাউর রহমানকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। গণমাধ্যমের কাছে বহিষ্কারের সত্যতা স্বীকার করেছেন আতাউর। বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত তাকে জানানো হয়েছে বলেও জামায়াতের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে।

জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, জামায়াতের কোনো কেন্দ্রীয় নেতাকে বহিষ্কার করার কিছু নিয়ম রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে প্রথমে তদন্ত করতে হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদে উঠাতে হবে এবং নির্বাহী পরিষদের বেশির ভাগ সদস্য একমত হলে বহিষ্কার করা যাবে। কিন্তু আতাউর রহমানের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম মানা হয়নি। এর ফলে আমীর মকবুল আহমাদসহ সংশ্লিষ্টরা স্পষ্টত দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করেছেন।

জানা গেছে, বর্তমান আমীর মকবুল এ নিয়ে বড় পরিসরে দু’বার গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করলেন। এর আগে সেক্রেটারি জেনারেল নিয়োগেও তিনি গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করেছেন। সেক্রেটারি নিয়োগে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্যদের পরামর্শ নেয়ার বিধান থাকলেও তা মানেননি মকবুল। এ কারণে গত বছরের ডিসেম্বরে এক বৈঠকে ব্যাপক তোপের মুখে পড়তে হয়েছে আমীরকে। ওই বৈঠকে মকবুল যুক্তিসঙ্গত কোনো জবাবও দিতে পারেননি। জামায়াতের কারও কারও ধারণা, শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতার সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ রয়েছে। নিজেরা নিরাপদ থাকতে হয়তো মকবুল ও ডা. শফিকের কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।

এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে জামায়াতের ওই নেতা বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবরে আমীর হিসেবে শপথ নিয়েছেন মকবুল আহমাদ। কিন্তু এর মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি দেননি। শুধু বিবৃতি দিয়েই তারা শান্ত থাকছেন। এখন নতুন করে আমীর ও সেক্রেটারির অনুসারীরা বলতে শুরু করেছেন জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করা ঠিক হয়নি। ভুলভাবে সংগঠন পরিচালনার কারণেই আজ সংগঠন দুর্বল হয়েছে। তাদের কথার সঙ্গে সরকারি দলের নেতাদের কথার অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।’

গঠনতন্ত্র পরিবর্তন : প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জামায়াতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের ভূমিকায় ছিল রুকন সম্মেলন। দলের প্রায় ৪০ হাজার রুকন (সদস্য) এ ফোরামের সদস্য। তাদের ভোটে আমীর ও মজলিশে শূরার সদস্যরা নির্বাচিত হতেন। সম্প্রতি গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে রুকনদের ভোটাধিকার রহিত করা হয়েছে। রুকনদের প্রতিনিধিরা (কাউন্সিলররা) ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। রুকন হওয়ার যোগ্যতাও কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।

সংশোধিত গঠনতন্ত্রের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ১. জাতীয় কাউন্সিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ ফোরাম হিসেবে গণ্য হইবে। ২. জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যদের সরাসরি গোপন ভোটে আমীরে জামায়াত নির্বাচিত হবেন। ১৪ (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, জামায়াতের আমীর, জেলা ও মহানগর আমীর এবং জেলা, উপজেলা ও থানার মজলিশে শূরার সব সদস্য জাতীয় কাউন্সিলের সদস্য হবেন। রুকনের মধ্যে যারা দলীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, তারাও জাতীয় কাউন্সিলের সদস্য হবেন। কাউন্সিলের মেয়াদ তিন বছর। পরিবর্তিত গঠনতন্ত্রে আমীরের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত আমীরের অনির্দিষ্টকাল দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখা হয়েছে। কর্মপরিষদের অনুমোদনে যুক্তিসঙ্গত সময় পর্যন্ত আমীর নির্বাচনের সুযোগও বহাল রাখা হয়েছে। এছাড়া ২৮ বছর পর সাংগঠনিক সম্পাদক পদ ফিরিয়ে এনেছে দলটি। সংশোধিত গঠনতন্ত্রের ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, আমীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাংগঠনিক সম্পাদক নিয়োগ করতে পারবেন।

তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন, সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের আর্থিক অনুদানে সংগঠন পরিচালিত হয়। যথাযথভাবে আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ ও অডিট করা হয়। তাই এখানে তহবিল তসরুফ করার কারও কোনো সুযোগ নেই। আর আতাউর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn